Wednesday, 14 September 2016

ঈদে বিশ্বাস করেন না তসলিমা নাসরিন!

মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদে বিশ্বাস করেন না তসলিমা নাসরিন। বুধবার নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে এ কথা বলেন তিনি। পূর্বপশ্চিম পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে দেওয়া হলো-
কাল ঈদ ছিল, রাতে টের পেয়েছি। যখন ফেসবুকে ঢাকার রাস্তায় রক্তের স্রোত দেখলাম, তখন। গত ২২টা বছর অধিকাংশ সময় এভাবেই পার করেছি। এভাবেই না জেনে। আমি ধর্মে বিশ্বাস করি না, ঈদে বিশ্বাস করি না। কবে ঈদ, এ খবর জেনেই বা আমার কী। না, আমার কিছু না। ঈদের দিনগুলোয় আমাদের অবকাশে মা-বাবা ভাই বোন যে যেখানেই থাকি, মিলিত হতাম। ঈদ ছিল আমাদের জন্য একটা গেট টুগেদার উৎসব। মা ছাড়া ধর্মে টর্মে বাড়ির কেউ বিশ্বাস করতো না। ২২ বছর দেশের বাইরে।
ঈদের সময়, ওই গেট টুগেদার উৎসবের সময়ও কেউ স্মরণ করে না আমাকে, না পরিবারের কেউ, না আত্মীয় স্বজনের কেউ। এখন তো মা নেই, বাবা নেই, ছোটদাও নেই। বড়দা, যাকে দাদা বলে ডাকি, শুনেছি ইদানীং সে হঠাৎ ধার্মিক হয়ে উঠেছে। ছোটদা’টা আবার পাঁড় নাস্তিক হয়ে উঠেছিল তার অসুখের সময়। দাদা এদিকে দাঁড়ি রাখছে, নামাজও নাকি দিনে পাঁচ ওয়াক্ত পড়ছে। মা যখন দাদাকে নামাজ পড়তে বলতো, দাদা বলতো, ‘মা, আল্লাহ আমাকে দিয়ে নামাজ না পড়ালে আমি কী করে নামাজ পড়বো, আমার কি কোনও শক্তি আছে নামাজ পড়ার?’ দাদাকে এখন মহান আল্লাহ তায়ালা হঠাৎ করে বুড়ো বয়সে কেন নামাজ পড়াচ্ছেন কে জানে! নামাজ রোজায় দাদার গভীর বিশ্বাস জন্মেছে। অসুখ বিসুখ হলে কেউ কেউ ধার্মিক হয়ে ওঠে, কেউ কেউ ধর্ম ত্যাগ করে। আমার দুটো ভাইয়ের মধ্যে এ দুটো ব্যাপারই দেখেছি।
কিন্তু যাইহোক, আমি তো তার বোন। ২২ বছরে আমাদের পুরোনো গেট টুগেদারের দিনে একবার কেন কারও আমাকে মনে পড়ে না? একবার কেউ কেউ ফোন করে না। একটিবার খোঁজ নেয় না। আমার তো কোথাও আর স্বজন নেই, পরিবার নেই। দাদা তার নিজের বউ ছেলে নিয়ে তার শ্বশুর-শাশুড়ি শালা-শালি নিয়ে ঈদের উৎসব করে। সেই অবকাশেই করে, যে অবকাশ ছিল আমাদের মিলিত হওয়ার বাড়ি। আমিই হয়তো একা স্মৃতি কাতর। আমারই হয়তো চোখে এক সমুদ্র জল। আর সবাই হয়তো বিয়োগের ঘরে অনেক আগেই, আমার জানার বোঝারও অনেক আগে আমাকে বসিয়ে রেখেছে। আমি এখন তাদের কোথাও আর নেই। না সম্মুখে, না হৃদয়ে। আমি দূরের এক অতীত। ভুলে যাওয়া একটা নাম শুধু।
লেখিকা: নির্বাসিত লেখিকা

ধর্ম ও রাষ্ট্রধর্ম

লিখেছেন

ধর্ম বলতে সাধারণত: আমরা দু’ধরণের ধর্মের কথা বুঝে থাকি। এক-মানুষ বা বস্তুর সহজাত ধর্ম, দুই-উপাসনা ধর্ম (worship religion) ।

সহজাত ধর্ম হল একটি মানুষের বা বস্তুর বৈশিষ্ট্য বা গুণাগুণ, ইংরেজিতে যাকে বলে properities ।যেমন-পানির ধর্ম-সমুচ্চশীলতা, নীচের দিকে প্রবাহিত হওয়া, অগ্নি নির্বাপন করা, আমাদের তৃষ্ণা মেটানো, ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বাস্প হয়ে যাওয়া, শূণ্য ডিগ্রি সেলসিয়াসে বরফ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। আগুনের ধর্ম পোড়ানো, তাপ সৃষ্টি করা, বাতাসের ধর্ম প্রবাহিত হওয়া, অক্সিজেন দ্বারা আমাদের জীবন রক্ষা করা ইত্যাদি। তারা কোন উপাসনা করে না । ফলত: তাদের কিংবা অন্য যেকোন বস্তুর কোন উপাসনা ধর্ম নেই । উপাসনা ধর্ম আছে একমাত্র মানুষের। একমাত্র মানুষই তার নিজের ধর্ম অনুসারে উপাসনা বা প্রার্থণা করে থাকে।

রাষ্ট্র কি? খুব সহজভাবে বললে-একটি ভূ-খণ্ড, সে ভূ-খণ্ডে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী এবং সে জনগোষ্ঠীর সম্মতিতে এবং তাদের প্রতিনিধিত্বের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি সরকার বা কর্তৃপক্ষ-যার প্রধান কাজ হল উক্ত ভূ-খণ্ডের জনগোষ্ঠীর সার্বিক কল্যাণ । এ অর্থে রাষ্ট্রকে একটি সংঘ বা সমিতিও বলা যেতে পারে। রাষ্ট্র কি কোন জৈবিক সংস্থা?-না। রাষ্ট্র কি কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি?-তাও না। বস্তুত রাষ্ট্র একটি কনসেপশন বা ধারণা। তাকে বুঝা যায়-ধরা-ছোয়া যায় না। তাই রাষ্ট্রের যে ধর্ম, তাহল রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট-যেমন-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র, রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ইত্যাদি । রাষ্ট্র যে বৈশিষ্ট্যেরই হউক না কেন, তার কোন উপাসনার প্রয়োজন নেই, সে উপাসনা করে না । রাষ্ট্রের মাথায় টিকি, টুপি পড়ানো যায় না, রাষ্ট্রকে খৎনাও করানো যায় না। রাষ্ট্র উপাসনা করে না । কারণ কোন রাষ্ট্র স্বর্গ বা নরকে যাবে, এমন অদ্ভূত দাবী কেউ কখনো করে না। সুতরাং তার কোন উপাসনা ধর্মের প্রয়োজন কেন থাকবে?

যারা বলেন-সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হিসাবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রাখলে ক্ষতি কি? তাদের বিষয়টি অন্যভাবে ভেবে দেখতে বলি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশ বলে যদি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা যুক্তিসঙ্গত হয়, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর দেশের রাষ্ট্রধর্ম কেন সনাতন হিন্দু ধর্ম হবে না, আর,এস,এস, এর রামরাজ্যের দাবীর আমারা কিভাবে বিরোধীতা করব? সংখ্যাগরিষ্ঠ খৃষ্টান ও বৌদ্ধদের দেশের রাষ্ট্রধর্ম কেন খৃষ্টানধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম হবে না।

তা যদি আমরা মেনে নিই, তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে ? বিশ্বের সকল দেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে কোন না কোন ধর্ম থাকবে । তাহলে ফলাফল কি দাঁড়াচ্ছে্? প্রত্যেক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্মের বাহিরের জনগোষ্ঠী হীনমন্যতায় শুধু ভুগবে না, তাদের অনেক ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান পালন থেকেও তারা বঞ্চিত হবে। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে আজ যত মুসলিমদের বসবাস, মুসলিম প্রধান নয়, এমন দেশগুলোতে মুসলমানদের সংখ্যা তার চেয়ে ঢের বেশী । তাহল কি দাঁড়াচ্ছে?

প্রায় প্রত্যেক দেশেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিগৃহীত কিংবা তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হবে। নীট ফলাফল দাঁড়াবে-বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিমও তাদের ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। তা কি আমাদের কাম্য হতে পারে?

এ কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, যারা রাষ্ট্রের সাথে কিংবা রাজনীতির সাথে ধর্মকে মিশিয়ে ফেলতে চান, তারা আসলেই ফেরেববাজ,শঠ, কিংবা মধ্যযুগীয় পশ্চাতপদতাকে আকঁড়ে থাকা বিভিন্ন ধর্মের গণ্ডমুর্খ মৌলবাদী গোষ্ঠী । ধর্মকে তারা কেবল রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। তাদের কেউই প্রকৃত অর্থে ধার্মিক কিনা প্রশ্ন করা যায়।

আমরা কেন ভুলে যাব, গণআন্দোলনের তোড়ে স্বৈরাচারী এরশাদের গদি যখন টলটলায়মান, তখন সে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার মাধ্যমে চমক সৃষ্টি করে শেষ রক্ষা পেতে চেয়েছিল। ব্যক্তি জীবনে এরশাদ যে কেমন ধার্মিক, তার ফিরিস্তি দেওয়ার কি কোন প্রয়োজন আছে?

এবার আসি ঐতিহাসিক পটভূমিতে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে এ উপমহাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন সফলতার দ্বার প্রান্তে, তার শেষ পর্যায়ে নানা রাজনৈতিক চক্রান্তের ফলশ্রুতিতে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। তার শোষণ নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্খা থেকেই এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন-বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তিতে।

আমাদের সেদিনের শ্লোগান ছিল-জাগো, জাগো-বাঙ্গালি জাগো। তুমি কে, আমি কে-বাঙালি, বাঙালি। এ বাঙ্গালি জাতির মধ্যে ছিল হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, আরো বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় । যে কারণে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর আমাদের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনার প্রতিফলন হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজিত হয়েছিল । আজ আমাদের রাষ্ট্র যদি সে অবস্থা থেকে সরে আসে, তাহলে তা হবে মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের সাথে চুড়ান্ত বেঈমানী। সেটাই যদি আমরা মেনে নিই, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বাগাড়ম্বরতার কোন অধিকার আর আমাদের থাকে না।

দেশের কতিপয় প্রতিতযশা নাগরিক তথাকথিত রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে যথার্থভাবেই একটি রীট করেছিলেন দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আদালতে । এ জাতীয় রীটকে আইনের ভাষায় বলা হয়-Public interest litigation (PIL) বা জনস্বার্থে মামলা-যা দেশের যে কোন নাগরিক অবশ্যই করতে পারেন। আইনের ছাত্র হিসাবে আমাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারকদের অভিমত শুণে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। ঐ রীট দাখিল করার এখতিয়ার বা Locus standi না থাকার অজুহাত তুলে তারা রীট পিটিশনটি খারিজ করে দিয়েছেন। আহা-মরি মরি। দেশের সংবিধান নিয়ে কথা বলার কিংবা মামলা করার Locus standi বা এখতিয়ার যদি বাংলাদেশের কোন নাগরিকের না থাকে, তাহলে সে এখতিয়ার কার থাকবে? তাহলেতো দেশের সংবিধান-যাতে বলা আছে জনগণ হল দেশের মালিক-তা পাল্টাতে হয়। মাননীয় বিচারপতিদের এ প্রশ্নের জবাব একদিন দিতে্ই হবে।

আদালতের এ আদেশে, অর্থাৎ মামলা খারিজের কারণে যারা উদ্বাহু নৃত্য করছেন-তাদের বলি-এ কিন্তু শেষ নয়। সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, অগ্রগতির চাকাকে কখনো কখনো পেছনে টানা যায়-কিন্ত তা সাময়িক-চুড়ান্ত বিচারে সমাজ এগিয়েই চলেই । আজকের যুগে এগিয়ে যেতে হলে, উন্নত সমাজ গড়তে হলে,মানবাধিকার সংরক্ষণ, সুশাসন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন অগ্রগতি অর্জন করতে হলে, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই। বিজ্ঞান ভিত্তিক সেকু্লার রাষ্ট্র ছাড়া কোন রাষ্ট্র আধুনিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠতে পারে না।

বাজারে মাছ কিনতে গেলে আগে আমরা মাছের কানকো উল্টিয়ে দেখি-মাছে পচন ধরেছে কিনা। কারণ মাছের পচন মাথা থেকে শুরু হয়। একটি জাতির পচন্ও নাকি শুরু হয় তার মাথা থেকে। মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ বা রায় তার প্রতিফলন কিনা জানি না । জীবনানন্দ দাশের প্রিয় কবিতাটি দিয়ে আমার এ লেখা শেষ করতে চাই-

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই–প্রীতি নেই–করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

জঙ্গীবাদ মৌলবাদের হিংস্র রূপ : সাংস্কৃতিক লড়াই দিয়েই তাকে রুখতে হবে

লিখেছেন

সরকারী অথর্ব মন্ত্রী-আমলারা স্বীকার করুক বা না করুক-ধর্ম নিরপেক্ষতার চেতনা নিয়ে নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ, ক্রমে জঙ্গীবাদীদের-তথা ইসলামী জঙ্গীবাদের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে । জঙ্গীবাদীদের প্রথম শিকার মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনস্ক লেখক, অত:পর ক্রমান্বয়ে সংস্কৃতিবান শিক্ষক, ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তি, ভিন্ন ধর্মীয় পুরোহিত, সর্বেশেষে স্বধর্মীয় ভিন্ন মতাবলম্বী মোল্লা মৌলবি ।

প্রথম প্রথম যখন জঙ্গীবাদীরা কেবল মুক্তমনা ব্লগার, লেখক-প্রকাশকদের হত্যা করা শুরু করে, তখন সরকারকেও তেমন উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায় নি । অধিকন্তু সরকার ও সরকারী মন্ত্রীরা মুক্তমনা লেখক ও ব্লগারদের তাদের লেখা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার নসিহত করতে থাকেন । তাই অসম্ভব সম্ভাবনাময় বিজ্ঞান লেখক ড. অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে সরকারী কর্তাব্যক্তিদের এতটুকু উদ্বেগ ও সহানুভূতি দেখাতেও দেখা যায় নি । এ সুযোগে জঙ্গীবাদীরা একে একে অনেক ব্লগার ও লেখক-প্রকাশককে হত্যা করে পার পেয়ে যায় । কিন্তু জঙ্গীবাদীরা যখন ক্রমান্বয়ে তাদের থাবা আরো বিস্তৃত করতে থাকে, তখন সরকারী মহল একটু নড়াচড়া শুরু করে। কিন্তু ইতোমধ্যে প্রায় শতাধিক ব্যক্তি জঙ্গী হামলার শিকার হলেও একটি হত্যাকাণ্ডের বিচারও সরকার করতে পারে নি। যার নিষ্করুণ পরিণতিতে জীবন দিল পুলিশ সুপারের নিরিহ স্ত্রী।

সর্বসম্প্রতি জঙ্গী দমনের অজুহাতে সরকার যে পুলিশী অভিযান শুরু করেছে-তাতে হাজার হাজার লোক ইতোমধ্যে কারবন্ধী হয়ে চরম নিগ্রহের শিকার হচ্ছে । সে হাজার হাজার গ্রেপ্তারকৃত ব্যাক্তিদের মধ্যে পুলিশী ভাষ্য মোতাবেক সন্দেহভাজন জঙ্গীর সংখ্যা হাতেগুণা-কয়েক শ’ মাত্র । দু:খজনক ব্যাপার হল-পুলিশী অভিযানের মধ্যে জঙ্গীরা তাদের কিলিং মিশন চালু রাখে । বলাবাহুল্য, জঙ্গীদের রণকৌশলের কাছে আমাদের পুলিশ বাহিনী অসহায়। তাই সেদিন আমাদের পুলিশ বাহিনী জঙ্গীদমনের নতুন ও অভিনব কৌশল হিসাবে সাধারণ মানুষের হাতে বাঁশের লাঠি ও বাঁশি ধরিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল-লাঠি-বাঁশি-বন্দুক-রাইফেল-র‌্যাব-পুলিশ দিয় কি জঙ্গীবাদের উত্থান ঠেকানো যাবে?

মৌলবাদ থেকেই জঙ্গীবাদের উদ্ভব
এ কথা আমাদের মানতেই হবে, ধর্ম থেকেই ধর্মীয় মৌলবাদের জন্ম। বিশ্বে ধর্মের সংখ্যা সহস্রাধিক । কোন ধর্মই তার শ্রেষ্ঠত্বের দাবী পরিহার করে নি। প্রত্যেক ধর্মানুসারীদের দাবী হল-তাদের ধর্মই একমাত্র সহিহ ধর্ম এবং শ্রেষ্ঠ ধর্ম । এ বোধের একটি বাস্তব কারণও আছে বৈকি । কারণ অন্য ধর্মের সঠিকত্ব স্বীকার করে নিলে নিজের ধর্মের প্রয়োজনীয়তা নি:শেষ হয়ে যায়।

প্রত্যেক ধর্মই শান্তির কথা বলে, ন্যায্য কথা বলে,উদানৈতিক ধার্মিকেরা ইত্যাদি দাবী করলেও মজার ব্যাপার হল-যে সকল ধর্ম ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, আর যে সকল ধর্ম ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না-তারা সকলেই প্রা্য় পরস্পর বিরোধী । ইসলাম ধর্মেতো ইহুদী-নাসেরাদের সাথে বন্ধুত্ব করতেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে । সে কারণে একজন সত্যিকার ধার্মিকের পক্ষে অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করা প্রায় অসম্ভর ব্যাপার । ধর্ম সাম্প্রদায়িকতার জন্মও কিন্ত এখানেই।

তাহলে মৌবাদের উৎস কোথায়?
প্রায় প্রত্যেক ধর্মের একটি মৌলিক আদি গ্রন্থ আছে । ইসলাম ধর্মের এ মৌলিক গ্রন্থ আলকুরআন এবং প্রত্যেক মুসলিম বিশ্বাস করে, কুরআন হল আল্লাহের প্রেরিত গ্রন্থ-যা আল্লাহ তার প্রেরিত পুরুষ হযরত মোহাম্মদ(স:) এর মাধ্যমে মানবজাতির জন্য প্রেরণ করেছেন । ঈশ্বর বিশ্বাসী সকল ধর্মের অনুসারীদের একই বিশ্বাস-তাদের ধর্মগ্রন্থ ঈশ্বর প্রেরিত। যেহেতেু ঐ ধর্মগ্রন্থ ঈশ্বর প্রেরিত, সেহেতু এ গ্রন্থ অভ্রান্ত এবং কোন অবস্থাতেই সে সকল গ্রন্থের কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন, সংযোজন করা মনুষ্য কর্তৃক সম্ভব নয়। ধর্ম মানলে ঐ সকল ঐশী গ্রন্থে যাই লেখা আছে-তাই মানতে হবে। যুক্তির বিবেচনায় দাবীটা সঠিক বৈকি । অর্থাৎ যখনি আবির্ভুত হউক না কেন, জন্মকালীন ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতিনীতির বিন্দু-বিসর্গও পরিবর্তনের কোন অবকাশ নেই। পরিবর্তন করা হলে তা আর ঐশী বাণী থাকে না । এ ধারণা বা বিশ্বাসই মৌলবাদের উৎস-ভূমি।

কিন্তু সমস্যা হল বিশ্বে বর্তমানে বিদ্যমান ধর্মগুলোর আবির্ভাব ঘটেছে আজ থেকে হাজার হাজার বৎসর পূর্বে । এ হাজার হাজার বৎসরে মানুষের সমাজ ও সভ্যতার পিলে চমকানো বিকাশ ঘটেছে। যার ফলে আজ থেকে হাজার হাজার বছর পূর্বে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও জীবনাচরণের অভাবিত পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু ধর্মীয় গ্রন্থ এবং সে সকল গ্রন্থ নির্দেশিত জীবনাচরণ ও বিশ্বাস রয়ে গেছে অপরিবর্তিত । মধ্যযুগীয় ধর্মীয় দর্শনের সাথে আধুনিক দর্শনের বিরোধ এখানেই। এ ক্ষেত্রে সমঝোতার কোন অবকাশ নেই। যে কোন একটি অবস্থান আমাদের মেনে নিতে হবে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় আদি বিশ্বাস ও আচরণকে যারা দুর্লঙ্ঘনীয় মনে করেন, তারা কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে আদৌ কুণ্ঠিত হন না । বিজ্ঞানের প্রযুক্তিগুলোকে অবাধে গ্রহণ করলেও কেবল বিজ্ঞানের দর্শনকে মেনে নিতে তাদের যত আপত্তি । কারণ তাতে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এখানেই হল ধর্মীয় মৌলবাদীদে স্ববিরোধীতা ।

মৌলবাদ থেকে কিভাবে জঙ্গীবাদের জন্ম
প্রত্যেক ধর্মের মৌলবাদীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো-তারা তাদের ধর্মের মৌলিক বিধি-বিধানকে সমাজ ও রাষ্ট্রে অবিকল ভাবে প্রয়োগ করতে চায়। তারা রাষ্ট্রের ও সমাজের সকল দিগনির্দেশনার জন্য ধর্মের আদিম ধারণা বা বিধি-বিধানকে অনুসরণ করে। মুসলিম মৌলবাদীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের তাবৎ সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের পবিত্র ধর্ম-গ্রন্থ কুরআন ও সুন্নাহের উপর নির্ভর করতে চায় । কুরআন যেহেতু ঐশী গ্রন্থ এবং হযরত মুহাম্মদ(দঃ)আল্লাহের প্রেরিত পুরুষ, সেহেতু কুরআন ও সুন্নাহের (নবীর জীবনাচরণ) বাহিরে কোন দিগনির্দেশনা মুসলমানেরা মানতে নারাজ ।

ইহুদী মৌলবাদীরা তোরাহ্ এর আক্ষরিক ব্যাখ্যার বাইরে বিন্দু-বিসর্গ যেতে প্রস্তুত নয়। খৃষ্টান মৌলবাদীরা প্রায় সকল প্রশ্নে বাইবেলের শিক্ষা অভ্রান্ত বলে দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করে। সাধারণভাবে সকল ধর্মের মৌলবাদীরা, প্রাণীজগত ও পৃথিবী সৃষ্টি-রহস্য নিয়ে তাদের স্ব স্ব ধর্মের ব্যাখ্যাকে অভ্রান্ত মনে করে-যদিও এসব ব্যাপারে ধর্মগ্রন্থগুলোর ব্যাখ্যা পরস্পর বিরোধী।
মৌলবাদীদের এ ধারণা যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা হয়, তখন রাষ্ট্র পরিচালনায় সাধারণ জনগণের মতামত গ্রহণ-এমনকি বৈজ্ঞানিক-যুক্তিনির্ভর কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও কোন সুযোগ থাকে না। সবকিছু যেহেতু ধর্মের আদি নির্দেশ অনুসারে করতে হবে, সেহেতু এখানে কেবলমাত্র ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রাহ্য করা যেতে পারে। তাই ধর্মভিত্তিক বৃহৎ রাজনৈতিক দল “জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ” এর জন্মদাতা মওলানা মওদুদী পশ্চিমা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন। ইরানী বিপ্লবের নেতা আয়তুল্লাহ খোমেনি ইসলামী ব্যবস্থাকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের বিপরীত প্রত্যয় (Anti-thesis) বলে উল্লেখ করেছেন ।

গণতন্ত্রের বদলে স্বেচ্ছাচার, মত প্রকাশের স্বাধীনতার বদলে বাক স্বাধীনতার কঠোর নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে নাগরিক অংশ গ্রহণের বদলে সে সুযোগের সংকোচন-এ সবই মৌলবাদী প্রশাসনের অন্তর্গত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই যেহেতু শুধুমাত্র ধর্ম-নির্দেশিত অনুশাসন প্রবর্তন করতে হবে, সেহেতু এসব নিয়ে বিতর্ক বা ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগও সেখানে থাকে না । আইন বা নৈতিক প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার/যোগ্যতা শুধুমাত্র ধর্মশাস্ত্রে পণ্ডিত ব্যক্তিরাই রাখেন, ফলে অন্য কারো মত গ্রহণের প্রশ্নই ওঠে না। খোমেনি তার “কাসাফ আসরার” গ্রন্থে ধর্মশাস্ত্রের গুঢ়ার্থ উদ্ধারের চেষ্টার বিরুদ্ধে সাবধান করে বলেছেন-একমাত্র তারাই এর অর্থ বুঝতে পারবে, যারা আরবী ভাষায় বিজ্ঞ, বার ঈমামের শিক্ষার সাথে সুপরিচিত ও ধর্ম শাস্ত্র অধ্যয়নে সুদীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন।

তাহলে ধর্মের যতই উদারনৈতিক ব্যাখ্যা দেওয়া হউক না কেন, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র কখনো (আধুনিক) গণতান্ত্রিক হতে পারে না । তাই যারা ধর্ম-ভিত্তিক রাষ্ট্রের কথা বলেন, আবার জোটবদ্ধ নির্বাচন করে পশ্চিমা গণতন্ত্রের সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছেন এবং হতে চান, তাদের চরিত্রের স্ববিরোধীতা অত্যন্ত প্রকট । পৃথিবীতে অনেক রাষ্ট্র আছে, যাদের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ হল মুসলমান । সে অর্থে তারা মুসলিম রাষ্ট্র। তাদের মধ্য থেকে কোন রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল হিসাবে ধরতে গেলে সৌদি আরবকেই সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিতে হয়। মাটির নীচে অগাধ (তবে অফুরন্ত নয়) তেল সম্পদের কারণে সে দেশ আজ একটি ধনী দেশ হলেও তার আর্থ-সামাজিক কাঠামোটি কেমন? যুগ যুগ ধরে সে দেশে শরিয়া আইনের নামে চলছে বাদশা শেখ আব্দুল আজিজ এর একটি গোষ্ঠীতান্ত্রিক পারিবারিক শাসন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোর সর্বত্রই একটি পরিবারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ। রাষ্ট্র পরিচালনায় দেশের জনগণের বিন্দুমাত্র অংশগ্রহণ নেই। সে দেশের অগাধ তেল সম্পদ লুঠেপুটে খাচ্ছে তারা। আর তাদের তখ্ত-তাউসকে নিরাপদ রাখার জন্য তারা পদলেহন করছে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের-বিনিময়ে যারা লুঠে নিচ্ছে তাদের তেল সম্পদ।

চুরি করলে প্রকাশ্যে হাত কেটে ফেলা, বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের জন্য কোমর-সমান মাটিতে পুঁতে প্রকাশ্যে পাথর ছুঁড়ে মারা সহ একটি মধ্যযুগীয় বিচার ব্যবস্থা সে দেশে প্রচলিত-যেখানে আধুনিক বিচার পদ্ধতি অনুপস্থিত। মানুষের বাক-স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, ইত্যাকার মৌলিক মানবাধিকারের বালাই নেই। পরিহাসের বিষয় হলো, আরবী শেখরা পেট্রোডলারের বদৌলতে আধুনিক প্রযুক্তির সকল সুফল নিংড়ে নিয়ে অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবন যাপন করলেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আকঁড়ে রেখেছে মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারনা ও মূল্যবোধকে-কেবল আপামর জনগণকে শোষণ ও অবদমনের জন্য।

আজ সর্বাপেক্ষা নিগৃহীত সে দেশের নারী সমাজ-যারা বস্তুতঃ এখনো অবরোধবাসিনী-মোঠা অঙ্কের যৌতুক না পেলে যাদের পাত্রস্থ পর্যন্ত করা হয় না । তবুও প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত অঢেল তেল সম্পদ তাদের জনগণকে দারিদ্র্য থেকে রক্ষা করেছে। অপরাপর আরব দেশগুলোর অবস্থা ও তদ্রুপ।

বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে আফগানিস্তানের তালেবান রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা আরো লোমহর্ষক-ভয়াবহ-বীভৎস।
কিন্তু মৌলবাদীরা যখন দেখে দেশে প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতারোহণ করে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে পারবে না, তখন তারা মনে করে জোর প্রয়োগ করে বা তথাকথিক জিহাদের মাধ্যমে তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করকত হবে এবং তা করার ব্যর্থ প্রয়াসে বিকল্প হিসাবে তারা জঙ্গীবাদের আশ্রয় গ্রহণ করে। কিংবা তারা মনে করে মুসলমানদের সমাজে যারা মুক্তমনা, আধুনিক চিন্তার মানুষ, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে-তাদের ধরে ধরে খুন করলে সমাজে ইসলামী শাসন প্রয়োগ সহজ হবে।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সূচনা
মৌলবাদ বাংলাদেশে জঙ্গিরূপ ধারণ করেছে-বিগত ১৭ই আগস্ট, ২০০৫ ইং সালে একই সাথে ৬৩টি জেলায় বোমাবাজি-ধারণাটিকে তর্কাতীত করে তুলেছিল। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মঘাতী বোমা হামলার মাধ্যমে দু’জন বিচারকসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবি ও নিরীহ মানুষ মারা গেছেন । ইতিপূর্বে মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের সাথে গাঁটছড়া-বাঁধা ৪ দলীয় জোট সরকার দৃঢ়তার সাথে দেশে মৌলবাদী শক্তির অস্থিত্বই অস্বীকার করেছেন । জঙ্গি তৎপরতার সংবাদ পরিবেশনের জন্য উল্টা সংবাদ মাধ্যমকে দায়ী করেছেন-দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপপ্রয়াসের অভিযোগ তুলে। কয়েকজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার ও বিদেশী সাংবাদিককে বহিস্কার করেছেন। “বাঙলা ভাই-’ইংরেজী ভাই” নামে কেউ নেই বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারংবার তার ‘বাংলিশ’ ভাষায় গলাবাজি করেছেন।

পরিতাপের বিষয়-জঙ্গীবাদীদের অস্থিত্ব স্বীকারের প্রশ্নে বর্তমান সরকারের অবস্থানও একই রকম। এদের কাছেও সবচেয়ে মূল্যবান তাদের ভাবমূর্তি । তাই একের পর এক চাপাতীর কোপে মুক্তমনা, প্রগিতশীল, বিজ্ঞানমনষ্ক এমনকি ভিন্ন মতাবলম্বী ধর্মীয় মোল্লা-পুরোহিত খুন হলেও তারা স্বীকার করতে নারাজ, দেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটছে। কিন্তু আজ মৌলবাদ যখন জঙ্গীরূপে আবির্ভূত হয়ে জাতীয় নিরাপত্তাকেই হুমকীর মুখোমুখী করেছে, তখন কর্তাব্যক্তিরা বোল পাল্টিয়ে বলতে শুরু করেছেন-এটা একটা গ্লোবাল সমস্যা।

মৌলবাদের উত্থানকে অস্বীকার করে-প্রকারান্তরে তাকে প্রশ্রয় দিয়ে-যে অন্যায় বিগত ৪ দলীয় জোট সরকার করেছেন, তার চেয়ে গুরুতর অন্যায় তারা করেছেন অপরাধীদের না ধরে-বিরোধী দলের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে-শূণ্যে তরবারি ঘুরিয়ে-জনগণের জীবনকে নিরাপত্তাহীন করে দিয়ে । একই ঘটনার পুণরাবৃত্তি করছেন বর্তমান সরকারও ।
ফলশ্রুতিতে আজকের বীভৎস বাস্তবতা হল-আমাদের রক্তমূল্যে কেনা প্রিয় স্বদেশভূমি আজ উগ্র-পশ্চাদপদ-মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারনায় বিশ্বাসী কতিপয় গোঁড়া ইসলাম-ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতে আক্রান্ত । বলা বাহুল্য, তাদের প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে পৃষ্ঠপোষকতা করছে একাত্তুরের সে পরাজিত জামাত-শিবির চক্র।

সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর বেদনাক্নিষ্ট প্রশ্ন হল-ইতিহাসের নজিরবিহীন আত্মত্যাগের মাধ্যমে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের জঠর ছিঁড়ে নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া একটি রাষ্ট্রে মৌলবাদের এ বিপজ্জনক উত্থান কিভাবে সম্ভব হল? বাঙালি জাতির সমকালীন ইতিহাসের এটাই বোধ হয় সর্বাপেক্ষা নির্মম পরিহাস-দুর্বোধ্য স্ববিরোধীতা (A historical paradox)। এ স্ববিরোধীতার ব্যাখ্যার মধ্যেই নিহিত আছে একে রোখার সঠিক পথ ও পন্থার সন্ধান।

বাঙলাদেশে মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটঃ
ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্রের জাতিগত শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এর ফলশ্রুতি আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। সঙ্গত কারণেই ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র আমাদের ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে সংবিধানে গৃহীত হয়। একটি স্বল্প-শিক্ষিত, দারিদ্রক্লিষ্ট জনগোষ্ঠির এ অর্জন-রাষ্ট্র পরিচালনায় উপরোক্ত আদর্শগুলোকে নীতিমালা হিসাবে গ্রহণ-ছিল বাস্তবিকই অভাবনীয়-যা পশ্চিমা বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক অগ্রগতির পর অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে একটি স্বল্প-শিক্ষিত ও পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর এ অর্জনের তাৎপর্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না । তাই আমরা অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধু সরকার মাদ্রাসা শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া শুরু করেন। অথচ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে-রাজাকার-আলবদর বাহিনী সৃষ্টির মাধ্যমে-তাদের নব্বই শতাংশের উপরে ছিল মাদ্রসার ছাত্র ও শিক্ষক। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকদের একাধিক সভা-সমাবেশে দুঃখের সাথে কথাটি উল্লেখ করলেও তার সরকার ইসলামী ফাউণ্ডেশন সৃষ্টি করলেন । ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সে ইসলামী ফাউন্ডেশন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মৌলবাদীদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল । তারপরও ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম রাষ্ট্রীয় নীতিমালা হিসাবে বহাল ছিল-ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ ছিল এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ অবারিত ছিল না।

কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগষ্ট মাসে এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতাচ্যূত করে যারা ক্ষমতাসীন হল, তারা সর্বাগ্রে তাদের এ অপকর্মের বৈধতা দিতে জনগণের সামনে আবির্ভূত হল ধর্মের আলখাল্লা পড়ে । এতবড় একটা জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মাথায় কালটুপি ও মুখে আল্লাহ-রসুলের নাম নিয়ে মঞ্চে আবির্ভূত হল খুনী মোস্তাক-প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিভূ হিসাবে । ক্ষমতাসীন হয়েই মোশতাক তার পরিহিত কাল টুপিকে জাতীয় টুপি ঘোষণা করেছিল । এ প্রতিবিপ্লবের সুবিধাভোগী হিসাবে ক্ষমতাসীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান দেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র মুছে দিলেন। নৃতাত্ত্বিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে নিয়ে আসলেন বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদ । অর্থনৈতিক নীতিমালার ক্ষেত্রে অধনবাদী বিকাশের পথ-যা সমকালীন উন্নয়নশীল দেশগুলেতে সঠিক উন্নয়ন কৌশল হিসাবে খুবই জনপ্রিয় ছিল-পরিহার করে ধনবাদী বিকাশের পথ গ্রহণ করলেন। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার পরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগে একাত্তুরের যে সকল যুদ্ধাপরাধী বিচারের অপেক্ষায় ছিল তাদেরও ক্ষমা করে দিলেন । জামাতে ইসলামী সহ ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে ধর্মের নামে রাজনীতি করার লাইসেন্স ফিরিয়ে দিলেন। জামাতের আমীর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে দেশে এনে রাজনীতিতে পূনর্বাসিত করলেন। কতিপয় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ-বিশেষভাবে সৌদী আরবের আর্থিক সাহায্য নিয়ে জামায়াতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক প্রচারণা তীব্রতর করল-যার মূল লক্ষ্য ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভুল প্রমাণ করা এবং বাংলাদেশকে তথাকথিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রে রূপান্তর করা।

পচাঁত্তরের পট পরিবর্তনের পর ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতা আদায় ও আমজনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবার জন্য ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা শুরু করল পূর্ণোদ্যমে। মেজর জিয়া তার সকল বক্তব্য শুরু করার আগে প্রকাশ্যে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” বলা শুরু করলেন।
জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতাসীন খলনায়ক, তুলনাহীন দুশ্চরিত্র হোসেন মোঃ এরশাদ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দিলেন একই লক্ষ্যে-তার সব অপকর্মকে বৈধতা দেওয়া। তিনি সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশটাকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের দিকে এক ধাপ এগিয়ে দিলেন ।

ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের সাথে এরশাদ রাজনীতিতে পীরতন্ত্রের প্রবর্তন করে নতুন মাত্রা যোগ করলেন । তিনি প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বিভিন্ন পীরের কাছে যেতে শুরু করলেন এবং এসব গণ্ডমুর্খ ও ভণ্ড পীরের উপদেশ প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রচার করতে ভালবাসতেন । রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারকে এরশাদ এমন এক হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, যখন তার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন তীব্র হয়ে উঠল, তখন তিনি প্রতি শুক্রবারে কোন না কোন মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যেতেন। মসজিদে গিয়ে তিনি পূর্বরাত্রে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে সেই মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে এসেছেন বলে ডাহা মিথ্যা অবলিলায় বলে যেতেন । অথচ মানুষ জানত, এরশাদ আসবেন বলে দু’ তিন দিন পূর্ব থেকেই সরকারী লোকেরা ঐ মসজিদ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা ও নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত ছিল।

এরশাদের পতনের পর প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচনী কৌশল হিসাবে নগ্নভাবে ধর্ম ও ভারত বিরোধীতাকে কাজে লাগাল। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারে তারা এতটুকু গেল যে, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে ধর্ম চলে যাবে, মসজিদে মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি হবে-দেশ ভারতের অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হবে-ইত্যাকার কথা জোরেশোরে বলে বেড়াতে লাগল । বলাবাহুল্য তারা এ অপকৌশলে সফল হয়ে নির্বাচনে জিতেছিল এবং ক্ষমতাসীন হয়ে তারাও রাজনীতিতে-রাষ্ট্রীয় আচারানুষ্ঠানে-ধর্মের ব্যবহার বাড়িয়ে দিল।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় এবং বিরোধী প্রচারণার জবাবে-তাদের রাজনৈতিক আচার-আচরণেও ধার্মিকতা প্রদর্শণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হল। জয় বাঙলা শ্লোগানের সাথে তারা ও “লা-ইলাহা ইল্লালাহু-নৌকার মালিক তুই আল্লাহ-প্রভৃতি শ্লোগান উচ্চারণ করতে লাগল।

বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় বিভিন্ন উপনির্বাচনে বিএনপির সীমাহীন কারচুপি একটি দলীয় সরকারের অধীনে যে কোন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলল। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানকে স্থায়ীরূপ দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করল। সে আন্দোলন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ যুগপৎ কর্মসূচী গ্রহণ করল জামায়াতে ইসলামীর সাথে। আন্দোলনের মুখে প্রথমে বিএনপি একতরফা একটি নির্বাচন-অতঃপর সে নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন পাশ এবং সে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি সরকারের সর্বাত্মক ব্যর্থতার পটভূমিতে আবারো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পটপরিবর্তন হল।

সুদীর্ঘদিন পর এবার ক্ষমতায় এল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্ববধায়ক সরকারের আন্দোলন করতে গিয়ে জামায়াতের সাথে অঘোষিত ঐক্য করে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কী ক্ষতিটা আওয়ামী লীগ করেছে, সে উপলব্ধি আওয়ামী নেতৃত্বের এখনো হয়েছে কিনা জানি না। শুধু তা নয়, আওয়ামী লীগ ও তার রাজনৈতিক আচরণে এমন কিছু পরিবর্তন আনল, যা প্রকারান্তরে ধর্মীয় রাজনীতিকেই উৎসাহিত করল। দীর্ঘদিন পর ক্ষমতাসীন হয়ে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূনর্বাসনের তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগত গ্রহণ করলই না, বরং তাদের দলীয় কর্মসূচী এবং রাষ্ট্রীয় কর্মসুচীতে তারা ধর্মীয় আচার-আচরণ অনুসরণ করতে শুরু করল পূর্ণোদ্যমে। সংসদে প্রত্যেক সাংসদদের মাথায় টুপি পরে বসা এবং যে কোন বক্তব্যের শুরুতেই জোর গলায় “বিসমিল্লাহীর রাহমানির রাহিম” বলা, কোন কিছুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে মোনাজাত করা, যে কোন অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কুরআন থেকে তেলোয়াত করা, নেতা-নেত্রীর ফি বছর হজ্জ করা ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মীয় আচরণের সাথে রাজনৈতিক আচরণকে গুলিয়ে ফেলে অপরাপর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণের সাথে আওয়ামী লীগের আচরণের পার্থক্য নির্ণয় করা দুরূহ হয়ে পড়েছিল-যা বস্তুতঃ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকেই বৈধতা প্রদান করছিল।

মজার ব্যাপার হলো, ক্ষমতাসীন হয়ে বিএনপিতো নয়ই, আওয়ামী লীগও এরশাদ প্রণীত রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করার কথা চিন্তাও করল না। কিন্তু এত কিছু করেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেমন থাকতে পারল না, তেমনি যে সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর মন জয় করার জন্য আওয়ামী লীগ এতকিছু করল-তাদের মন থেকেও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা মুছে ফেলতে সক্ষম হল না। বরং জাতীয়তাবাদী দল আরো এক ধাপ এগিয়ে জামাতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট নামক দলের সাথে জোট বেঁধে নির্বাচন করে পুণর্বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসল।

ক্ষমতাসীন হয়ে ৪ দলীয় জোট সরকার ধর্মপালনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের কাঁধে তুলে দিল। ক্ষমতান্ধ হয়ে এ সামান্য বোধটুকু আমাদের জাতীয়তাবাদী নেতারা হারিয়ে ফেলল যে, রাষ্ট্র একটি সামাজিক সংগঠন-কোন সংগঠনের কোন ধর্ম থাকে না । ধর্ম, তথা উপসনা-ধর্ম (worship religion) থাকে মানুষের-কোন বস্তু বা সংগঠনের নয়। বস্তু বা সংগঠনের ইহকাল পরকাল নেই। তারা স্বর্গ-নরকে যাবে না। তাই তাদের ধর্মের প্রয়োজনও নেই। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্ম পালনের ফলে প্রকারান্তরে বৈধতা পেল ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। এভাবে সেক্যুলার রাজনীতির শিকড় কাটা হতে লাগল একে একে।

অত:পর ৪ দলীয় জোট সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, অপশাসন, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রীত্বের আসনে বসানো ইত্যাকার কার্য়ক্রমের ফলে জনগণ বিএপি এর নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট কে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করল । উল্লেখ্য যে, নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যু্দ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার প্রদান করেছিল।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, পাকিস্তানী রাজনীতিবিদরা যেভাবে ক্ষমতার স্বার্থে তিলে তিলে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করে পাকিস্তানকে একটি ধর্মভিত্তিক সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন, র্ঠিক সে পথেই আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তারই ফলশ্রুতিতে আজ জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটছে।

মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ রুখতে চাই শিকড়-নাড়া সাংস্কৃতিক লড়াই
মৌলবাদী শক্তিকে কেবল রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করে-ঊনিশ শ’ একাত্তুরে যেমনটি আমরা করেছিলাম-রোখা যাবে না। চুড়ান্তভাবে ঠেকাতে হলে তাকে রুখতে হবে আদর্শিকভাবে। সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা মাদ্রাশাগুলোতে শিক্ষার নামে যা ছড়ানো হচ্ছে, তা মূলত: ধর্মাশ্রয়ী কুপমণ্ডুকতা ও অজ্ঞতা। অথচ মৌলবাদের প্রধান আশ্রয় হল অজ্ঞতা। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও নারী শিক্ষার বিস্তার সে অজ্ঞানতা রোধে প্রধান ভূমিকা নিতে পারে। বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক শিক্ষা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসার ঘটাবে ও তার লালন মৌলবাদী অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে বর্ম হিসাবে কাজ করবে। এ লক্ষ্য অর্জনের প্রধান শর্ত হচ্ছে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিযুক্ত করা। মৌলবাদীদের সন্তুষ্ট করার জন্য সরকার যদি একের পর এক ধর্ম পালনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়, তাতে মৌলবাদের ভিত্তি কেবল শক্তই হবে। তাই বৈজ্ঞানিক যুক্তি বিস্তারের মাধ্যমে সর্বাগ্রে আমাদের মৌলবাদী মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার অসারতা, অপ্রাঙ্গিকতা-পশ্চাদপদতা ও গণবিমুখতা তুলে ধরতে হবে আম জনগণের কাছে-বিশেষভাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে। সেজন্য একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।

মৌলবাদের মূল উৎস যেহেতু ধর্মীয় গোঁড়ামী এবং এ গোঁড়ামীর উর্বরক্ষেত্র যেহেতু অশিক্ষা-কুশিক্ষা, সেহেতু তাকে রুখতে হলে আমাদের সর্বাগ্রে শিক্ষা, বিশেষভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে শিক্ষা ব্যবস্থার মূল স্রোতে সামিল করতে হবে। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করতে হবে এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।

একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক কাঠামো, বেকারত্ব দূরীকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচন, আইনের শাসন কায়েম,সুশাসন প্রতিষ্ঠা, গ্রাম ও শহরের বৈষম্য দূরীকরণ-বিশেষভাবে গ্রামীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি আশু পদক্ষেপ মৌলবাদ উত্থানের বিরুদ্ধে বর্ম হিসাবে কাজ করবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, স্রোতস্বিনী নদীতে যেমন কোন শেওলা-শৈবাল জন্মাতে পারে না, তেমনি একটি আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক, গণতান্ত্রিক ও উন্নত আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে মৌলবাদসহ কোন প্রকার কুসংস্কারের আগাছা শিকড় গাড়তে পারবে না। এভাবে মৌলবাদী দর্শনকে পরাভূত করতে পারলে জঙ্গীবাদ রুখে যাবে।

Monday, 12 September 2016

রওশন জামিল- নারী জাগরণের আরেক পথিকৃৎ

লিখেছেন

লিখেছেনঃ অরুণাভ বিলে

বাংলাদেশের খুবই পরিচিত নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী রওশন জামিল বড় হয়ে উঠেছিলেন এমন একটা সময়ে যখন মেয়েদের বিশেষ করে মুসলিম মেয়েদের বাইরে নাচগান বা অভিনয় করা কথা চিন্তাও করা যেত না । ৫০-এর দশকে যখন মেয়েদের চরিত্রে ছেলেদের মেয়ে সেজে অভিনয়ের চল ছিল তখন রওশন জামিল জগন্নাথ কলেজে শরৎচন্দ্রের দেবদাসে অভিনয় করেন । তাঁর পেশাদার অভিনয় জীবন শুরু হয় ৬০এর দশকে টেলিভিশন নাটক ‘রক্ত দিয়ে লেখা’য় ।

রওশন জামিল জন্ম নিয়েছিলেন একটি রক্ষনশীল পরিবারে । কিন্তু ভাই-বোন দের মধ্যে ছিল শিল্প চর্চার প্রতি তীব্র অনুরাগ । সেকালের এমন একটি পরিবারে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল তা রওশন জামিল নিজেই বলেছেন বিবিসি বাংলাকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে । সেটি আগে তুলে ধরছি । “আমার বাবা তিনটে বিয়ে করেছিলেন, আমরা তিন মায়ের ভাইবোনই এক বাড়িতেই বড় হয়েছি । সেজন্য বাড়িটা আনন্দভুবনের মত হয়ে গেছিল । এক এক ভাই এক এক টাইপের, এক এক জন এক একটা পছন্দ করছে । কেউ খেলাধুলা করছে, কেউ বাগান করছে, ব্যাডমিন্টন কোর্ট বানাচ্ছে, এমন কি আমাদের বোন দের জন্যও আলাদা কোর্ট তৈরি করেছিল । রাতে খেলা হচ্ছে, সেই মজার ব্যাপার । হৈহুল্লুর হত, বাসায় অনেক রকম লোক আসত । আমার বড় যে ভাই বাগান করতেন তিনি একটু বেপরোয়া ছিলেন, তিনি বাগান করতেন, ভায়োলিনও শিখতেন । ছোটভাই গিটার আর বড় ভাই সেতার শিখতেন । অন্য বোনকে গানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ।”

তিনি ছিলেন তার বাবার ছোট ঘরের মেয়ে । সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি যেহেতু ছোট মায়ের মেয়ে তাই আমাকে অন্য মায়েদের ভাইবোনদের কাছ থেকে দূরে রাখা হত । আমার মা ধর্মভীরু লোক ছিলেন, তিনি ভাবতেন ওরা করছে করুক কিন্তু আমার মেয়ে পাক্কা মুসলিম ফ্যামিলির মেয়ের মত মাথেয় ঘোমটা থাকবে সবসময়, নামায পড়বে, কুরান শরীফ পড়বে । জোরে কথা বলবে না, জোরে হাসবে না এভাবে আমার মেয়ে একজন খামদানি মুসলমান হবে । এবং উর্দুতে কথা বলতে হবে, বাংলায় কথা বললে তো ঠিক মুসলমান হওয়া যায় না ।

আমাদের ভাইবোনদের ভাল লাগত বাংলা, ভাল লাগত গান বাজনা । চুপিচুপি করে মায়ের চোখ থেকে এড়িয়ে গিয়ে, বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সবার সাথে খেলাধুলা করতাম । আমাদের বাড়ি ছিল বিশাল বড়, এক কিনারে কি হচ্ছে আরেক কিনারের মানুষ জানে না । তাই অন্যদিকে গিয়ে সবার সাথে মিশে আমরা ওগুলো শিখতাম, অন্তত আমি শিখতাম, আমার ভাল লাগত । আমার ইচ্ছে হলে আমি দৌড়ে চলে যেতাম নদীর তীরে- সদরঘাটে । নৌকায় উঠে বসতাম, মাঝি বলত কোথায় যাবেন ?? আমি বলতাম যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যাও । সেখানেই নিয়ে যেত, সেখানে নামতাম, গ্রাম দেখতাম, ঘুরতাম, ওরা আমাকে বলত আপনি এখানে নামবেন ?? দেখতাম ঘুরে আবার ফিরে আসতাম, কোন ভয় করত না । কিন্তু ওরা আমার কাছ থেকে টাকাপয়সা নিত না কোন । বিরাট একটা মজা ছিল, কত আনন্দ !! কেউ কিছু বলছে না, কেউ কিছু ধরছে না । পাখির মত ঘুরতাম, পাখিও এত নিরাপদে ঘোরে না ।

নৃত্যশিল্পী হিসাবেই তিনি প্রথমে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন । ৬০ এর দশকে তিনি আস্তে আস্তে অভিনয়শিল্পের দিকে ঝুকে যান । এপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ছবির সাথে যখন বেশি জড়িত হয়ে গেলাম, তখন ছবি করব না সংসার করবো ! না বাগান করবো ! না নাচবো ! তা তো আর হল না, কাজেই তখন আমার নাচ গ্যাপ পরে গেল । আর প্রায়ই দেখতাম যে এখানে ভীষণ বয়স হিসাবে কাউন্ট করে, কে কতোটা বয়সী কিন্তু কে কতোটা ভাল নাচছে কেউ সেটাকে পাত্তা দিত না । সোজা কথা যে ভাল নাচানাচির ব্যাপার না, ব্যাপার হল গিয়ে আপনার বয়স হয়ে গেছে, আপনি সংসার করছেন, বাচ্চাকাচ্চার মা হয়ে গেছেন, ফিগার যতোই ভাল রাখেন না কেন আপনি এখন আর নাচবেন না । আপনি পথ ছাড়েন, নতুন মেয়েরা যারা আসছে তারা নাচবে, তারা বাইরে যাবে কিন্তু আপনি কেন যাবেন ? আপনি গেলে দেশের একটা লজ্জ্বা । কিন্তু আমার স্বামী গেলে লজ্জ্বা না, আমার স্বামীর বয়স বাড়ে না । বয়স বাড়ে খালি আমার, মানে মেয়েদের বয়স বেড়ে যাইতেছে কিন্তু ছেলেদের বয়স বাড়ে না ।

এরপর ষাটের দশকে তিনি অভিনয় জগতে প্রবেশ করেন । অনেক টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এই গুণী অভিনেত্রী । তিনি নিজ মুখেই বলেছেন তিনি অভিনয় আর নৃত্যের মধ্যে নৃত্যের প্রতিই বেশি দুর্বল ছিলেন । তিনি নাচের জন্য সাধনা করেছিলেন, গানের জন্য সাধনা করেছিলেন । অভিনয় ব্যাপারটাকে তেমন বড় কিছু মনে করেন নি তিনি । তার মতে অভিনয়ের চেয়ে নাচ বা গান অনেক সাধনার ব্যাপার এবং সেটা করেই তিনি বেশি আনন্দ পেতেন । নাচ বা গানের মাধ্যমে দর্শকদের হৃদয় জয় কয়াকেই তার বড় পাওয়া মনে হত । নৃত্য ব্যাপারটা যে তার কাছে সাধনার মত ছিল সেটা বোঝা যায় তার ছোট বেলার এই ঘটনায় । বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “ছোটবেলায় মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠেও তিনি নাচতেন, বড় বোনকে বলতেন নাচ তুলে দিতে । তার বাড়িতে কোন নাচের মাস্টার ছিল না, বড় বোন স্কুলে যা যা শিখতেন তাই ওনাকে শিখিয়ে দিতেন । বাড়িতে তার মা অনেক কন্সারভেটিভ ছিলেন বলে লুকিয়ে লুকিয়ে করতে হত । কিন্তু নাচ আর গান তার খুব ভাল লাগত । মাঝে নাচ, গান না করতে পেরে তিনি কাঁদতেন লুকিয়ে লুকিয়ে । একদিন তার মা দেখে ফেলেন এবং কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, পেট ব্যথা তাই । তার আশে পাশের তৎকালীন অন্যান্য অনেক মেয়েরা নাচ গান করতে পারতেছে কিন্তু তিনি পারতেছেন না । এজন্য তিনি কান্নাকাটি করেন । পুরাণ ঢাকায় বাড়ি হওয়ার জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন হিন্দুদের পূজার সাথে । দুর্গাপূজা, কালীপূজায় ইত্যাদি অনুষ্ঠানের সময় ঢাকের তালে তিনি নাচতেন । প্রায়ই বাড়ি থেকে বের হয়ে মন্দিরে চলে যেতেন, এরপর মনেহত রাত তো অনেক হয়ে গেছে- বাসায় খোঁজাখুঁজি করবে ।

সেকালের রক্ষণশীল পরিবার আর সমাজ তার নৃত্য প্রতিভার বিকাশে সৃষ্টি করেছিল নানানরকম বাঁধা । সেসকল বাঁধা অতিক্রম করে তার সংস্কৃতিচর্চা, নৃত্য সাধনা করা কোন সহজ কাজ ছিল না । তৎকালীন সময়ে কোন মুসলমান ঘরের মেয়ে নাচবে এটা চিন্তাই করা যেত না । আশেপাশের লোক লোকজন তাকে নিয়ে নানারকম কটুকথা বলত । কেউকেউ বলত তিনি বেলল্লাপনা করতেছেন । “সে যে এতগুলো ব্যাটাছেলের সামনে হেলেদুলে নাচে এটা কি কোন প্রংশার ব্যাপার ?? আমরা এরকম টাকাপয়সার মুখে থুথু ফেলি । এদিয়ে যদি জীবন চলতে হয় তারচেয়ে মরণও ভাল ।” তখনকার দিনে এসব সমাজের লোকেদের কটুকথা গ্রাহ্য না করে কতোখানি মানসিক শক্তি থাকলে একজন নারী সামনে দিকে এগিয়ে যেতে পারেন তার উদাহরণ হলেন শ্রদ্ধেয় রশন জামিল । নৃত্যকলায় তার অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালে তাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করেন ।

অভিনয় জীবন-
রওশন জামিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তার অভিনয় জীবন শুরু করেন । তার প্রথম অভিনীত নাটক রক্ত দিয়ে লেখা ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় । বাংলাদেশ টেলিভিশনের ঢাকায় থাকি ও সকাল সন্ধ্যা ধারাবাহিক নাটক তাকে আরও জনপ্রিয় করে তুলে । তিনি ১৯৬৭ সালে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন আরব্য রূপকথা আলিবাবা চল্লিশ চোর ছায়াছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে । ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান পরিচালিত জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রে আপা চরিত্র তাকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে আসে । তাছাড়া আমজাদ হোসেনের রচনা ও পরিচালনায় নয়নমনি, আবু ইসহাকের উপন্যাস অবলম্বনে শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকের পরিচালিত সূর্য দীঘল বাড়ী চলচ্চিত্রে তার অভিনয় দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে ।

জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) পরিচালক- জহির রায়হান, ছবির দৃশ্যে খান আতাউর রহমানের সাথে রওশন জামিল

জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) পরিচালক- জহির রায়হান, ছবির দৃশ্যে
খান আতাউর রহমানের সাথে রওশন জামিল

‘নয়নমণি’, ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘মাটির ঘর’, ‘বউ শাশুড়ি’, ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’সহ প্রায় তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি । এছাড়া টেলিভিশন, রেডিও এমন কি মঞ্চ নাটকেও তার উপস্থিত ছিলো লক্ষণীয় । দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী – নয়নমনি (১৯৭৬); শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী – সূর্য দীঘল বাড়ী (১৯৭৯) এছাড়াও টেনাশিনাস পদক, সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ড, বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার, তারকালোক পুরস্কারসহ বহু পদক ও পুরস্কারে ভূষিত হন ।

তার অভিনীত কিছু বিখ্যাত চলচ্চিত্র-
• চিত্রা নদীর পারে (১৯৯৯) • ওরা ১১ জন (১৯৭২) • সূর্য দীঘল বাড়ি (১৯৭৯) • শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯) • জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) • শঙ্খনীল কারাগার (১৯৯২) • তিতাস একটি নদীর নাম (২০০২) • রামের সুমতি (১৯৮৫) • দেবদাস (১৯৮২) • শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯)

ব্যক্তিগত জীবন-
রওশন জামিলের জন্ম ১৯৩১ সালের ৮ মে, ঢাকার রোকনপুরে। শিক্ষা জীবন শুরু করেন লক্ষ্মীপুর সেন্ট ফ্রান্সিস মিশনারি স্কুলে । পরবর্তীতে ইডেন কলেজে পড়াশুনা করেন । অভিনেত্রী হিসেবে সুপরিচিত হলেও, শুরুতে নৃত্যের প্রতিই তার ঝোঁক ছিলো সেটা উপরের লেখাতেই স্পষ্ট এবং তিনি নিজের মুখেই সেটা বলেছেন । এ কারণে গহর জামিলের কাছে নাচের তালিম নিতে যান । কিন্তু ঘটনাচক্রে দুজনের মধ্যে মন দেয়া নেয়া হয়ে যায় । অবশেষ ১৯৫২ দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । এই দম্পতির দুই ছেলে ও তিন কন্যা । ১৯৫৯ সালে স্বামী গওহর জামিলের সঙ্গে ঢাকায় নৃত্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘জাগো আর্ট সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেন রওশন জামিল । ১৯৮০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর তিনিই এই সংগঠনের দেখাশুনা করতেন । জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সোমা মুমতাজ উনার ভাগ্নি, এবং বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী আলপনা মুমতাজ তার বোন এবং সোমা মুমতাজের মা ।

স্বামী বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী গহর জামিলের সাথে রওশন জামিল

স্বামী বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী
গহর জামিলের সাথে রওশন জামিল

রওশন জামিল ২০০২ সালের ১৪ মে বাংলাদেশের ঢাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন । বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার (এফডিসি) প্রবেশদ্বারে ‘নয়ন সম্মুখে তুমি নাই’ শিরোনামের ফলকে প্রয়াত চলচ্চিত্রকারদের সাথে তার নাম খোদাই করা আছে ।

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার মৃত্যুর একবছর আগেই জন্মেছিলেন রওশন জামিল । ব্রিটিশ বাংলার তৎকালীন রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন, এরপরে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ স্বাধীন হল জন্ম নিল ভারত- পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র । বঙ্গদেশের নাম হল পূর্ব পাকিস্তান । পরাধীন দেশের রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারে জন্ম নিয়ে তিনি অতিক্রম করেছিলেন সকল বাঁধা বিপত্তি । তৎকালীন বাঙ্গালী সমাজের মানুষের কটু কথা উপেক্ষা করতে কতখানি সাহস লাগে আর তা কিভাবে করতে হয় সেটা করে দেখিয়েছিলন রওশন জামিল । এই মহীয়সী নারীর জীবন থেকে আমাদের বর্তমান সমাজের মেয়েদের অনেক কিছুই শেখার আছে । কিন্তু আমি খুব একটা কেউকে রওশন জামিল নিয়ে কথা বলতে দেখি নি । নারী জাগরণে বেগম রোকেয়ার মত ভূমিকা না রাখলেও নিজের কর্মজীবনের মধ্যে তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর প্রচেষ্টা থাকলে যেকোন বিপদ, বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করা সম্ভব । কার কাছে কি জানি না, কিন্তু আমার কাছে তিনিও নারী জাগরণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবেন । আপনাকে শ্রদ্ধা ।

সাম্প্রদায়িক

লিখেছেন

লেখকঃ সৈয়দ ইমাদ উদ্দিন শুভ

 

বিস্তীর্ণ এক শহরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি,
চারদিকে মড়া আর লাশের স্তূপ; রক্তের গন্ধ, মাথার ওপর বিদীর্ন আকাশ,
যেখানে চিল, কাক আর শকুনের মত শিকারিরা করে খেলা;
চারদিকে কেবল মৃত উদ্ভিদ, শুকিয়ে যেন কাঠ; নদীতে কোন জল নেই,
কেবল রক্তের স্রোত আছে মিশে,
আর সেই লোহিত স্রোতে ভেসে আছে একগাদা মৃতদেহ- অর্ধগলিত,
হাঙরও সেখানে ভয় পায় আর কালো রঙ ধরে মেলে,
অদ্ভুত এক শহর; শুধু মসজিদ আর মন্দির আছে টিকে;
বাকি ঘর সব ছাই হয়ে গেছে, হিংসা অনলে মিশে।

আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে ধর্মাবমাননা ইস্যু ও বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান

লিখেছেন


ছবি-গোলাম সারোয়ার
সময়টি ছিল ৯২-্এর অক্টোবর মাস। ২২ অক্টোবর ডানপন্থী পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাবের মাধ্যমে বাজারে রটে যায়, ২১ অক্টোবর ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘে’র এক সেমিনারে আহমদ শরীফ বলেন, “ইসলাম টিকে আছে ইতরদের মধ্যে।” এই কথাটাকে উদ্ধৃত করে জামাত উন্মত্তের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন বদরুদ্দীন উমর! তিনি দৈনিক আজকের কাগজে ‘নাস্তিকতার আস্ফালন’ নামে একখানা লেখা লিখে ফেললেন। আহমদ শরীফের শাস্তির দাবীতে জামাতসহ প্রতিটি ইসলামিক দল রাস্তায় নেমে আসে। নিজামীর নেতৃত্বে জামাত সংসদে ওয়াক আউট করে। সংসদে নিজামী বক্তব্য দেওয়ার সময় বদরুদ্দীন উমরের লেখার কথা উল্লেখ করে আহমদ শরীফের শাস্তি দাবী করে। শোনা যায়, জামাত-শিবির বদরুদ্দীন উমরের লেখাটি নাকি সংসদেও জমা দেয়। বদরুদ্দীন উমর নাস্তিকতার বিরুদ্ধে কিংবা আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে লেখার অধিকার রাখেন না, কিংবা তিনি প্রতিক্রিয়াশীল এমনটি বলার যৌক্তিকতা নেই। তবে সময় জ্ঞান বিচারে কোন লেখা কখন লিখতে হবে এই বিবেচনা বোধ একজন বুদ্ধিজীবীর বা বামতাত্ত্বিকের কাছে আশা করা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়। বদরুদ্দীন উমরের লেখা তৎকালীন সময়ে যে ডানপন্থীদের আগুনে ঘি হিসেবে কাজ করেছে তা বললে অন্যায় হবে না। সে সময় আহমদ শরীফের বাড়িতে ইসলামপন্থীরা বোমা নিক্ষেপ করে। সৌভাগ্যবশত কেউ আহত হয়নি। বদরুদ্দীন উমর হয়তো ডানপন্থীদের খুশি করার জন্যে লেখাটি লেখেননি কিন্তু ওনার লেখার কারণে আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে ডানপন্থীদের আন্দোলন ও হুংকার আরও উস্কে দেয়। যেমনটি আমরা দেখেছি অভিজিৎ রায়কে হত্যা করার পর। নাস্তিকরা যখন হত্যার শিকার হচ্ছে তখন এই হত্যাকে থামানোর চাইতে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মাথাব্যথা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল অনলাইনের নাস্তিকতা। কোন সময়ে কোন লেখা কোন বক্তব্য মৌলবাদীদের উৎসাহিত করে কিংবা তাদের হত্যা, আক্রমণের বৈধতা দান করে এই বোধটুকু বুদ্ধিজীবীদের থেকে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করে। যদিও বেশির ভাগ সময় আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয় না। যেমন-হুমায়ুন আজাদের উপর হামলার ৪ বছর পর ১৮ জুলাই, ২০০৮ এক সাক্ষাৎকারে প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ; হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রমণকে প্রকারান্তরে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
“:বাংলাদেশের লেখকরা কী স্বাধীন?
-হ্যাঁ, বাংলাদেশের লেখকরা স্বাধীন।
:তাহলে ড. হুমায়ুন আজাদকে মরতে হলো কেন?
– কারণ যে বইটি (পাকসার জমিন সাদবাদ) তিনি লিখেছেন, তা এতই কুৎসিত যে, যে কেউ বইটা পড়লে আহত হবে। তার জনে মৌলবাদী হতে হয় না।” (সূত্র-দৈনিক সমকালের প্রকাশিত হুমায়ূন আহমদের সাক্ষাৎকার)
আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে জামাত ও ইসলামপন্থীদের রাজনীতির ইতিহাস বোঝার জন্যে সবার আগে সেই সময়টি সম্পর্কে ধারণা নেওয়া প্রয়োজন। সময়টি ১৯৯২ সাল, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিকে সাথে নিয়ে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালত করে গোলাম আজমের বিচারের আন্দোলন, ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে সারা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা ও উত্তেজনা, স্বৈরাচার বিদায়ের পর বিএনপির ক্ষমতার এক বছর, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে যখন রাজনৈতিক আঁতাত স্পষ্ট, ঠিক সেই সময় আহমদ শরীফের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে জামাত ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো মাঠে নেমে পড়ে। জাহানারা ইমামের গণআদালতের মতন তারাও হুংকার দেয়, সরকার যদি আহমদ শরীফের বিচার না করে তাহলে ইসলামপন্থীরা গণআদালতে আহমদ শরীফের বিচার করবে। তবে তৎকালীন পত্রিকা ঘাঁটলে স্পষ্ট হয় যে, সেই সময় এসব ডানপন্থী বা ইসলামপন্থী দলগুলোর সংবাদ পত্রিকার পাতায় ছোট্ট একটি কলামে প্রকাশ হতো। বেশির ভাগ সময় তাদের কর্মসূচী গুরুত্বহীন পাতায় ছাপা হতো। যাদের অবস্থান একসময় পত্রিকার গুরুত্বহীন পাতায় স্থান পেত, তারাই এখন পত্রিকার পাতার হেড লাইন হচ্ছে। তাদের হুংকার ধমকিগুলো পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ পাতায় ছাপা হচ্ছে। এই অবস্থানের মাধ্যমে আমরা তাদের অবস্থান ও শক্তি সম্পর্কেও ধারণা পাচ্ছি।

দৈনিক ইনকিলাব সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। স্বভাবসুলভ আচরণে বাবরি মসজিদের সময় পত্রিকাটি সংবাদ প্রকাশ করে-বাবরি মসজিদ ঘটনায় ঢাকার হিন্দুদের মিষ্টি বিতরণ! এই সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকায় হিন্দু পাড়াগুলোতে হামলা ও অগ্নি সংযোগ চলে। পরের দিন তারা এই ভুল সংবাদের জন্যে ক্ষমা চায়। যে উদ্দেশ্যে তারা এই খবর ছেপেছে তা ঐ রাতেই সম্পন্ন হয়েছে। “স্বদেশ চিন্তা সংঘ” এর সেমিনারের সংবাদ তৎকালীন প্রতিটি সংবাদ পত্র প্রকাশ করে। একমাত্র ইনকিলাব একটি উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে আহমদ শরীফের এক লাইনের এই বক্তব্যে কোট করে প্রকাশ করে। এর পেছনের উদ্দেশ্য পুরোটাই রাজনৈতিক। একই চিত্র আমরা দেখেছি, ২০১৩ সালে গণজাগরণ হওয়ার পর। গণজাগরণের পর ‘আমাদের দেশ’ পত্রিকা ব্লগারদের কিছু লেখা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে ছাপে। আর সেই ছাপার ভিত্তিতে নাস্তিকদের ফাঁসির দাবীতে রাস্তায় নেমে আসে হেফাজত ইসলামের নেতৃত্বে ইসলামপন্থীরা। যার পেছনে নলকাঠি নাড়াচ্ছিল জামাতসহ অন্যরা।
নাস্তিকদের বিচারের দাবীতে যখন ইসলামপন্থীরা রাস্তায় নামে তারা নাস্তিকদের বিচারের পাশাপাশি আহমদিয়া মুসলিম গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করার দাবীটিও সামনে নিয়ে আসে। আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ এবং ২০১৩ সালে ব্লগারদের বিচার ও ফাঁসির দাবীতে একই চিত্র দেখা যায়। ২০১৩ সালে হেফাজতের ১৩ দফার ৬ নম্বর দাবীটি ছিল আহমদিয়া (অপমানজনক শব্দ হিসেবে কাদিয়ানী বলা হয়) গোষ্ঠীকে পাকিস্তানের মতন রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে। এই দাবীটি ১৯৯২ সালে খতমে নবুয়ত এই দাবী তোলে। খতমে নবুয়ত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে আহমদিয়াদের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হামলা, নির্যাতন ও সুন্নি ইসলামে ধর্মান্তরিত করে আসছে। নাস্তিকতার সাথে আহমদিয়াদের সম্পর্কটি আসলে কোথায় তা এসব উগ্রবাদী ইসলামপন্থীরাই ভাল জানেন।

আহমদ শরীফের শাস্তির দাবীর সাথে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার সম্পর্ক ঠিক কোন জায়গা তা একমাত্র এসব ইসলামিক দলগুলোই বলতে পারবে।-১৯৯২ সাল।

২০০২ সালে হুমায়ুন আজাদের সময়ও আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবী। যেমনটি ২০১৩ সালে হেফাজত ইসলাম দাবী তোলে।

২৪ অক্টোবর ১৯৯২-দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত বিভিন্ন সংগঠন ও দলের অবস্থান:
তৎকালীন জামাতের ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান আহমদ শরীফের শাস্তি দাবী করে (২৩ অক্টোবর) বলেন, কতিপয় মুখচেনা ব্যক্তি মাঝে মধ্যে এই দেশের জনগণের আকিদা, ইমান পরিপন্থী বক্তব্য প্রদান করে পরিবেশ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করেন। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উল্টো এসব লোকদের একুশে পদক স্বাধীনতা পদক প্রদান করে ইসলাম বিরোধী কাজ উৎসাহিত করা হয়।ভবিষ্যতে যেন এমন কোন বক্তব্য কেউ দিতে সাহস না পায় তার জন্যে আহমদ শরীফের শাস্তি দাবী করে–ইত্তেফাক।
সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ. কে. এম নূরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেন-ড. আহমদ শরীফ মুসলমানদের মনে যে আঘাত দিয়েছে তা সাংবিধানিকভাবে অবশ্যই বিচারযোগ্য। তিনি আশা করেন সরকার তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিবেন।
দাওয়াতী ইসলামী প্রধান ও বদরপুরের পীর মাওলানা আব্দুর রব আহমদ শরীফের ফাঁসি দাবী করে বলেন-তাহার মতন খোদাদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সকলকে সোচ্চার হতে হবে।
১২ জন আলেম এক যুক্ত বিবৃতিতে ইসলাম ত্যাগের কারণে আবার মুসলমান হইয়া তওবা করার জন্যে ড. আহমদ শরীফের প্রতি আহবান জানাইয়া বলেন, অন্যথায় তাহাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন- মাও: এ কিউ এম সিফাতুল্লাহ, জয়নাল আবেদীন, হাফেজ মহবুবুর রহমান, সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।
কাছেমাবাদ দরবার শরীফের পীর ও আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মুসলেমীনের সভাপতি মাওলানা আ. ক. ম ওয়াহিদ ড. আহমদ শরীফের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাইয়া তাহার কঠোর বিচারের ব্যবস্থা কতিতে সরকারের প্রতি দাবী জানায়। বাদ আসর বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেট থেকে ইসলাম শাসনতন্ত্র আন্দোলন ঢাকা মহানগর শাহার উদ্যোগে এক প্রতিবাদ মিছিল বাহির করা হয়। পরে প্রেস ক্লাবের সামনে কঠোর শাস্তি দাবী করা হয়। বক্তব্য রাখেন ব্যারিস্টার মোঃ কোরবান আলী, বরগুনার পীর মাও: আব্দুর রশীদ প্রমুখ।
এছাড়া; জাগপার সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান জাতীয় ওলাম পার্টির সভাপতি আলহ্বাজ মাওলানা আনিসুর রহমানসহ অন্যান্য নেতা, জাতীয় জনতা পার্টির নেতা মুজিবুর রহমান হিরুসহ অন্যান্য নেতা, হিযবুল ফালাহ’র আমীর মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন ও দপ্তর সম্পাদক মাওলানা ফারুক আল মামুন, আহলে সুন্নত ওরাল জামাতের আলহাজ্ব মাও: বাকী বিল্লাহ, ইসলামী যুব সেনার কাজী সাইফুদ্দিন হোসেন, জাতীয় ছাত্র সমিতির মাহমুদ্দুজ্জামানসহ ২১ জন ছাত্রনেতা, ডেমোক্রেটিক লীগের (ছাত্তার-পাঠান) সভাপতি আ: ছাত্তার পাঠানসহ অন্যান্য নেতা, ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মওলানা আ: সাত্তার ও যুগ্ম-সম্পাদক এডভোকেট ওবর আলী, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জ জেলা নেতা শামসুদ্দিন ভুঁইয়া ও আলী হোসেন কাজল, নারায়ণগঞ্জ মসজিদে হেফাজতে ইসলামের আলহাজ্ব মাও: আবদুল আউয়াল, ইসলামিক লেবার অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান আশরাফউদ্দিন আহমদ মুজাহিদ ও সেক্রেটারি অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম, ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা মহানগর শাখার মোঃ: ইসতিয়াজ আলম, তাহরিক-ই-খেলাফতের নেতা জেহাদি হুজুর, বরিশালের মূলাদী থানার সমাজকল্যাণ পরিষদ ও ইসলামী পাঠাগারের সভাপতি মাও: মু: ইসমাইল হোসেন সিরাজীসহ অন্যান্য কর্মকর্তা, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের শেখ আনসার আলী এমপি ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক হারুনুর রশীদ খান, ইত্তেহাদুল উম্মাহ’র মাওলানা মীর ফজলুর রহমান ও মাও: এ কে এম শামসুদ্দিন, ইসলামিক রিপাবলিকান পার্টির এডভোকেট মোঃ: হাবিবুউল্লাহ চৌধুরীসহ অন্যান্য নেতা ফকিরাপুলের ব্যবসায়ী আবদুল বাছেত মুন্সীসহ আরামবাগ ও মতিঝিল কলোনির এলাকার বিভিন্ন স্তরের ২৪ জন লোক, ওলামা পরিষদের সভাপতি আমীনুল ইসলাম ও সেক্রেটারি মাও: মাছুম হেলানী, দি ভোরাম অব ইঞ্জিনিয়ার্স এন্ড আর্কিটেক্টর সভাপতি প্রকৌশলী কাজী আবুল হাসনাত ও সম্পাদক প্রকৌশলী মোঃ: শহীদ খাজা হাসান এবং ফরিদাবাদ মাদ্রাসার শিক্ষক নুতিউর রহমানসহ এই লাইনের ১৩ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি গতকাল পৃথক-পৃথক সভা, সমাবেশে ও বিবৃতিতে ইসলাম ও মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতির উপর আঘাতের জন্যে আহমদ শরীফের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করেন। কেউ কেউ তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার কেউবা ফাঁসীর দাবী জানায়। এছাড়া সিলেটসহ সারাদেশে ইসলামপন্থী সংগঠনগুলো আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে মিছিল সমাবেশ করে শাস্তির দাবী তোলে।


বক্তব্যটি বিকৃতি করে প্রচার করা হয়েছে:
লেখক, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ ১৬ জন (দৈনিক বাংলা)/ ১৮ জন (ইত্তেফাক) বিশিষ্ট ব্যক্তি যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, দৈনিক ইনকিলাব চিরায়ত স্বভাব অনুযায়ী বক্তব্য বিকৃতি করে প্রচার করেছে। তারা বলেন- গত বুধবার স্বদেশ চিন্তা-সংঘের সেমিনারে ড. আহমদ শরীফ ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কোন কটূক্তি করেননি। পরের দিন বিভিন্ন পত্রিকায় ঐ সেমিনার সম্পর্কিত খবর পড়লেই এ কথার সত্যতা প্রমাণ হবে। বিবৃতি-দাতারা হচ্ছেন-বশীর আল হেলাল, অধ্যাপক মনসুর মুসা, ড. সাঈদ উর রহমান, অধ্যাপক আবুল কাশেম, ফজলুল হক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, আবদুল মতিন খান, ড. নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস, আজিজ মেহের, আব্দুল মান্না, শফিকুল হক স্বপন, অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, মুহম্মদ হাবিবুল্লাহ, খ ম আব্দুল আউয়াল, কল্লোল রায়, ও ইসরাইল খান। সাম্যবাদী দলের কেন্দ্রীয় সদস্য নাজমুল হোসেন এক প্রতিবাদে বিবৃতিতে অভিযোগ করেন, জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিটিকে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্যেই ড. আহমদ শরীফের বক্তব্যকে বিকৃত করে ছাপা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য অন্য কোন সংবাদ পত্রে এই বিকৃত বক্তব্যটি পরিবেশিত হয়নি। বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সভাপতি হাসান আজিজুল হক ও সাধারণ সম্পাদক আনু মুহাম্মদ এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, যে বক্তব্যকে বিকৃতি করে ছাপিয়ে এবং যে বক্তব্যের রেশ ধরে সারাদেশে সন্ত্রাসী আবহওয়া তৈরি করা হয়েছে। ঘটনাগুলো যেভাবে ঘটছে তাতে এটি যে একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত তা খুব স্পষ্ট। উক্ত বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ৭১-এর ঘাতক দালালসহ জামাত-শিবিরের মতন অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট শক্তিসমূহ ঘোলা জলে মাছ শিকারের চেষ্টায় নেমেছে। সারাদেশে ঘাতক-দালাল ও জামাত-বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্যে যে এই অপচেষ্টা তাকে কোন সন্দেহ নেই।


সংসদে জামাতের ওয়াক আউট:

২৫ অক্টোবর জামাত সংসদে ওয়াক আউট করে। প্রফেসর ড. আহমদ শরীফের “ধর্ম ও ইসলাম বিরোধী” বক্তব্যের উপর সংসদে মুলতবী প্রস্তাব গ্রহণে স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী অসম্মতি জানাইলে নিজামীর নেতৃত্বে ১৬ জন জামাতে এমপি ওয়াক আউট করে। সংসদে নিজামী নিজের বক্তব্যে আজকের কাগজে বদরুদ্দীন ওমরের লেখায়- ‘ধর্ম বিরোধী নাস্তিকতাবাদের হাতে বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্ব প্রদান করা করার যে আহবান’ উল্লেখ করে আহমদ শরীফের অবস্থা দাউদ হায়দার ও সালমান রুশদির মতন হতে পারে বলে হুশিয়ার উচ্চারণ করে। সে সময় তার বক্তব্যের সমালোচনা করেন সুরঞ্জিত সেন-গুপ্তসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য প্রতিবাদ জানায়।


শিক্ষকদের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান:

আহমদ শরীফ যেন ক্ষমা প্রার্থনা করে তার জন্যে ১২২ জন শিক্ষক বিবৃতি প্রদান করে। এই শিক্ষকরা কিছু উপদেশ প্রদান করে আহমদ শরীফকে তাদের লাইনে আসার অনুরোধ জানান। তবে একই সময়ে ১৩০ জন তরুণ লেখক শিল্পী সাংবাদিক আহমদ শরীফের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, আহমদ শরীফের বক্তব্য বিকৃতি করে উপস্থাপন করা হয়েছে।


ইসলামপন্থীদের গণআদালত গঠন করে আহমদ শরীফের বিচারের হুমকি:
গণআদালত করে আহমদ শরীফের বিচার করবে বলে হুমকি দেয় ইসলামিক দলগুলো। জাহানারা ইমামের গণআদালতের ন্যায় তারাও গণআদালত করবে। ২০১৩ সালে শাহবাগের পর যেমন নাস্তিক ইস্যু সামনে চলে আসছে ঠিক তেমনি সেই সময় আহমদ শরীফের নাস্তিকতা সামনে নিয়ে আসে ইসলামিক দলগুলো। সমাবেশে তারা ঘোষণা দেয় তারা কোন নাস্তিকের জানাজা পড়াবে না।



আহমদিয়াদের অফিসে হামলা:
খতমে নবুয়ুত আহমদ শরীফের শাস্তির পাশাপাশি আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করার দাবী জানায়। ৩০ নভেম্বর ১১৯৯২ সালে বকশি বাজারের আহমদিয়া জামাত অফিসে হামলা ও অগ্নিসংযোগ চালায় এতে আহত হয় ১২ জন।

তৎকালীন লেখক শিবির আহমদ শরীফের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিবৃতি দান করে। যদিও ছফার ভাষায় বর্তমান লেখক শিবির বদরুদ্দীন উমরের ভ্যানেটি রক্ষা ছাড়া কিছুই না। ছফা একটি সাক্ষাৎকারে ষ্পষ্টভাবে বলেন, পাকিস্তান আমলে বদরুদ্দীন ওমর ‘লেখক শিবিরের’ বিরোধিতা করেছিলেন, ৭১ এ বদরুদ্দীন ওমরের অবস্থান স্পষ্ট ছিল না। বদরুদ্দীন ওমর ১৯৯২ সালে বুঝে কিংবা না বুঝে আগুনে ঘি ঢাললেও ১৯৯৪ সালে তিনি আবার ব্লাসফেমি এ্যাক্ট প্রবর্তনের চক্রান্ত প্রতিহতের জন্যে যে মিছিল লেখক শিবির বের করে তাতে বদরুদ্দীন ওমর অংশগ্রহণ করেন। নাস্তিকতার আস্ফালন লিখেও তিনি আহমদ শরীফের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে পারতেন। কিন্তু আহমদ শরীফের পক্ষে তিনি নিরব অবস্থানে ছিলেন। বদরুদ্দীন ওমরের এমন অবস্থান পরিবর্তন সম্ভবত ওনার কিছুটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যেমন- রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে চ্যালেঞ্জ করে ২৮ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮৮ সালে স্বৈরাচার এরশাদের আমলে ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক করা রিট আবেদন করেন। বর্তমানে তাদের মধ্যে মাত্র ৫ জন বেঁচে আছেন-অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত, বদরুদ্দীন উমর, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ২০১৬ সালে সেই রিট শুনানি আবার হাইকোর্টে উঠলে সেখানে একমাত্র বদরুদ্দীন ওমর-ই নিজের নাম সরিয়ে নেন এবং পত্রিকায় বিবৃতি দান করেন।

সম্ভবত ১৯৯৪ সাল। মিছিলের প্রথম সারিতে বাঁ থেকে আজফার হোসেন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ, শামসুর রাহমান, পান্না কায়সার, সৈয়দ শামসুল হক। দ্বিতীয় সারিতে বাঁ থেকে আব্দুল মতিন খান, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হুমায়ুন আজাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও বদরুদ্দীন উমর। বাঙলাদেশ লেখক শিবিরের উদ্যোগে এই কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল। ছবি- আজফার হোসেন
আহমদ শরীফ রাজনীতি-সচেতন মানুষ ছিলেন। বামপন্থী মার্ক্সবাদী রাজনীতির ওপরে তাঁর আস্থা ছিল। তবে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন মুক্তমনা মানুষ, কাউকে কখন অন্ধভাবে পীর মানেননি। নাস্তিকতা সমর্পকে তিনি বলেন-“নাস্তিক্য কোন নতুন তত্ত্ব নয়,-সুপ্রাচীন, সবাই বলে সব কিছুরই স্রষ্টা আছে, গাড়ি-বাড়ির, জামা-কাপড়ের, বই-পত্রের যেমন নির্মাতা আছে, তেমনি জগতেরও স্রষ্টা থাকার কথা। এ কথাগুলো যুক্তিগর্ভ। কিন্তু তারা স্রষ্টাকে স্বয়ম্ভূ বলে। বিজ্ঞান বলে- সবকিছু একাধিক উপাদানে গঠিত। তাই যদি হয়, স্বয়ম্ভূ স্রষ্টায় সম্ভবত একাধিক উপাদানের সমষ্টি। তা হলে তার আগেও কিছু উপাদান ছিল, তা ছাড়া খালি-খোলা স্থান ও কাল পরিসরও ছিল নইলে স্রষ্টার স্ব হওয়ার ঠাঁই মিলত কোথায়! স্রষ্টার অস্তিত্ব লাভের আগেই যদি স্বয়ম্ভূ হবার প্রতিবেশ স্বয়ং তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে অন্য কিছুরও স্বয়ম্ভূ হবার পথে বাধা কি! কাজেই স্রষ্টা তত্ত্ব টেকে না ”
যখন তসলিমা নাসরিনের পক্ষে বাংলাদেশে প্রকাশ্যে কেউ নেই, সেদিনও স্যার ব্যক্তিগতভাবে তসলিমা নাসরিনের খোঁজ খবর নিয়েছেন এবং বক্তব্য-বিবৃতিও দিয়েছেন।
১৯৯১-৯২ সালে সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্মের জন্য সাংবাদিক বিপ্লব পাল ড. আহমদ শরীফের একটি সাক্ষাতকার নেন। সেখানে বিপ্লব পাল জানতে চান; পশ্চিমবাংলার বাম নেতা আজিজুল হককে উদ্ধৃত করে আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কী ধর্মহীনতা? ধর্মের উৎখাত? জবাবে তিনি খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গে বলেছিলেন: তা কেনো হবে? আমি তোমাকে পছন্দ করছি না, তাই বলে কী তোমাকে চড় লাগিয়ে দিতে হবে?
তবে লক্ষণীয় বিষয় হল, যাকে নিয়ে এতো রাজনীতি এতো আন্দোলন সেই ড. আহমদ শরীফ তার বক্তব্যের পক্ষে বিপক্ষে কোন বিবৃতি পত্রিকায় দেননি (কিংবা আমার চোখে পড়েনি)। ১৯৯২ সালে মৌলবাদীরা সমাবেশে ঘোষণা করে, তারা আহমদ শরীফসহ কোন নাস্তিকের জানাজা পড়াবেন না। আহমদ শরীফও ধর্মীয় নেতাদের জানাজা পড়ানোর অনুরোধ করেননি। ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯ শ্রদ্ধেয় মুরতাদ আহমদ শরীফ স্যার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মারা যাওয়ার আগে তিনি লিখে যান- আমার মৃত দেহ বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের গবেষণার জন্য দান করবেন। মরণোত্তর দেহ দান করার দলিলে স্পষ্ট করে লিখে দেন-“আমার জানাজার প্রয়োজন নেই”।
ছবি- ইরতিশাদ আহমদ
ছবি- ইরতিশাদ আহমদ
শুধু খোদাদ্রোহী আহমদ শরীফই নন, প্রগতিশীল খোদা প্রেমী লেখকরাও ধর্মবাদীদের হাতে নাজেহাল হয়েছে। যেমন মীর মশাররফের গো-জীবন পবন্ধের ব্যঙ্গাত্মক প্রতিবাদ তো করেইছে, ধর্মসভা ডেকে মীর মশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে কাফের ও তার স্ত্রী হারাম জারি করে। এছাড়া ধর্মবাদীদের হাতে আবুল হুসেনের অপমানিত এবং নিগৃহীত হওয়ার ইতিহাস আমাদের কারো অজানা নয়।
যে মানুষটিকে নিয়ে এতো কিছু সেই মানুষটি কখনো ধর্মীয় উন্মাদদের কাছে মাথা নত করেননি। জীবনের ভয়ে কিংবা ইহলোকিক কোন স্বার্থে নিজের অবস্থান থেকে দূরে সরে যাননি। লেখাটির শ্রদ্ধেয় মুরতাদ আহমদ শরীফের উক্তি দিয়েই শেষ করতে চাই-
“আমি সারাজীবন মোসাহেবি করে তোয়াজ-তোষামোদ-খোসামোদ করে, তদবির করে অপরের কৃপায় করুণায় তকদির তৈরির বা বদলানোর পন্থা মাত্রকেই ঘৃণা করেছি। বরং ক্ষতি স্বীকারের শক্তি অর্জনে ও রক্ষণে ছিলাম সদা সচেতন। তাই কোথাও কোন কৃপা-প্রসূন পদ-পদবি ছাড়াই আজো নিশ্চিত নিদ্রার, নিশ্চিত মনের অভীক চিত্তের অধিকারী হয়ে টিকে রয়েছি। তৃপ্ত-তুষ্ট-হৃষ্ট ও পুষ্ট হয়ে নিজের নীতি-আদর্শের মতে পথে সিদ্ধান্তে স্বাতন্ত্র্য রেখেও শরীরের অসুস্থতা নিয়েও সুখানন্দে আমার দিন কাটছে। পড়া-লেখা-আড্ডা আমার নিত্যদিনের কাজ।নাস্তিক বলে মৃত্যুভয়ও নেই” । – আহমদ শরীফ
[শত চেষ্টা করেও আজকের কাগজ-এ লেখা বদরুদ্দীন উমরের “নাস্তিকতার আস্ফালন” লেখাটি সংগ্রহ করতে সক্ষম হইনি। কারো কাছে যদি এই পত্রিকা কিংবা লেখাটি থেকে থাকে কিংবা বদরুদ্দীন উমরের কোন বইতে থেকে থাকে তাহলে জানালে কৃতজ্ঞ হবো। পত্রিকায় বদরুদ্দীন উমরের লেখাটির প্রকাশের তারিখ-২২ অক্টোবর থেকে ২৬ অক্টোবর এর মধ্যে, সাল-১৯৯২, আজকের কাগজ। ]

প্রথম নির্বাসিত কবি ও কবিতা

লিখেছেন |

দাউদ হায়দারের সাথে কী হয়েছিল, কেন তিনি দেশ ত্যাগ করেছেন তা নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। এছাড়া উইকিপিডিয়াতেও কবি সম্পর্কে অনেক তথ্য আছে। দাউদ হায়দারের সাথে কী ঘটেছিল, পত্রিকায় কী ছাপা হয়েছিল সেই বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে বুঝতে পারলাম; কবি সম্পর্কে কিছু ভুল সত্য সব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। যেমন- বলা হয় কবিকে গ্রেফতার করা হয়েছে ১৯৭৩ সালে। তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল। কারণ কবির সেই আলোচিত কবিতা “কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়” ছাপাই হয় ১৯৭৪ সালের ২৪ই ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায়। যাই হোক, কী হয়েছি তখনকার পত্রিকার কী লিখেছিল তা খুঁজে বের করা চেষ্টা করি। স্বাধীনতার পর মৌলবাদী দলগুলোর খুব বেশি শক্তি ছিল না, তারপরও কবিকে দেশে রাখা সম্ভব হয়নি। পত্রিকার পাতায় কী লেখা ছিল তাই দেখার চেষ্টা করব।
স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় ১৯৭৪ সালে দাউদ হায়দারকে দেশ ছাড়তে হয়। ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লেখেন। দাউদ হায়দার বিভিন্ন ধর্মের নবী ও অবতারদের নিয়ে কবিতাটি লেখেন। শুধু ‘সংবাদের সাহিত্য পাতা’য় ছাপান নি , বলা হয়- কবিতাটি বায়তুল মোকারামের সামনে নিজ হাতে ঝুলিয়ে দিয়ে আসেন। ঝুলিয়ে দেওয়ার গল্পটি সম্ভবত সত্য নয়। সাধারণত পাঠকদের জন্যে ভবনের দেওয়ালে পত্রিকা চিকা মারা হয়ে থাকে। সম্ভবত চিকা মারা কাগজের মধ্যে সেখানে কবির কবিতাটিও ছিল।
যাই হোক, ২৪ ফেব্রুয়ারিতে (১৯৭৪)তে কবিতাটি সংবাদের সাহিত্য পাতায় ছাপা হলে ঢাকা কলেজের এক শিক্ষক কবির বিরুদ্ধে মামলা করেন। এরপরেই কবির বিরুদ্ধে ধর্মবাদীরা কবির বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচী শুরু করে। ১১ই মার্চ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারণে কবিকে গ্রেফতার করা হয়।
দ ২
পত্রিকায় লেখা হয় যে, গতকাল (১১ই মার্চ) রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জনাব দাউদ হায়দারকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করে। ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যা’ নামে একটি কবিতা লেখার তাকে গ্রেফতার করা হয়। গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদে কবিতাটি প্রকাশিত হয়। গ্রেফতারের কারণ হিসেবে বলা হয়-দেশের বিপুল সংখ্যক জনসাধারণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত।দাউদ হায়দার ছিলেন দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক। এছাড়া ১৯৭৩ সালে তরুণ কবি হিসেবে আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও লাভ করেন।

কলকাতায়, কবি ছোট মা’য়ের সাথে (দ্বিতীয় মা)
১৯৭৪ সালের ১২ই মার্চ, দৈনিক ইত্তেফাক “কবিতাটি কেন্দ্র করিয়া” নামে একটি সংবাদ উপস্থাপন করে। সেখানে বলা হয়, দৈনিক সংবাদে ২৪শে জানুয়ারিতে দাউদ হায়দারের কবিতা প্রকাশ পাওয়ার পর গত গত (১১ই মার্চ) পাবনায়, রাজশাহী প্রকৌশলী কলেজে পূর্ণ দিবস হরতাল পালন করা হয়। কবিতা ছাপার প্রায় এক মাস বিশ দিন পর পাবনায় হরতাল পালন করা হয়। রাজশাহীর প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেন ভাসানীর ন্যাপ নেতা মশিউর রহমান। অথচ ফেব্রুয়ারি মাসের কোন পত্রিকায় দাউদ হায়দার কিংবা কবিতাটি নিয়ে কোন রিপোর্ট হয়নি। বিষয়টি স্পষ্টত যে, কবির বিরুদ্ধে মামলা ও ১১ই মার্চে গ্রেফতারের পরই এই ইস্যুতে কিছু জায়গায় হরতাল ডাকা হয়। ১১ মার্চে ইত্তেফাকের রিপোর্টে দেখা যায়; কবিতাটি প্রকাশের জন্যে দৈনিক সংবাদ ক্ষমা চায়। এবং কবিতাটি যারা ছাপিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও অঙ্গিকার করে। যদিও ৯ই মার্চ দৈনিক সংবাদে কবি কবিতাটির জন্যে ক্ষমা চেয়ে বলেন, কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া কবির ইচ্ছা ছিল না। আল্লাহ রসুল ও অন্য ধর্মের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। তিনি আরো বলেন কবিতাটি তিনি তার কোন কাব্য গ্রন্থে যুক্ত করবেন না।
ইত্তেফাক পত্রিকা এখানে ভুল করে ২৪শে জানুয়ারি লিখে ফেলে। যদিও অন্য জায়গায় সঠিক তারিখ ২৪শে ফেব্রুয়ারি লেখে।
ইত্তেফাক পত্রিকা এখানে ভুল করে ২৪শে জানুয়ারি লিখে ফেলে। যদিও অন্য জায়গায় তারা সঠিক তারিখ ২৪শে ফেব্রুয়ারি লেখে।
১২ই মার্চে বায়তুল মোকারমে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সংবাদ পত্রিকার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এবং ২৪শে ফেব্রুয়ারির পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করার জন্যে সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়। এর পর পত্রিকার কয়েকটি কপিতে অগ্নি সংযোগ করে, একটি মিছিল সংবাদ অফিসের সম্মুখে বিক্ষোভ করে ও ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। বাংলাদেশ সীরাত মজলিস, বাংলাদেশ সাবান শ্রমিক ইউনিয়ন তীব্র নিন্দা জানায়।
হুজুরদের বিক্ষোভ সমাবেশ
হুজুরদের বিক্ষোভ সমাবেশ
কবি ডালিম হোসেন এক বিবৃতিতে বলেন-আমি ব্যক্তিগতভাবে নবী মুহাম্মদের ভক্ত। অপর দুইজন ব্যক্তির আমার কাছে পরম শ্রদ্ধেয়। বিক্ষুব্ধ দেশবাসীর কাছে আমার আরজ, যে অপরাধ করিয়েছে, সে নিজে অপরাধ স্বীকারপূর্বক ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে-এর চেয়ে বড় প্রতিকার ও প্রতিশোধ আর কিছুই হতে পারে না। ক্ষমা ও সহৃদরতা ছাড়া এখন আর কিছুই তার প্রাপ্য নয়। মহানবীর জীবনকালে যদি এ-ঘটনা ঘটত তা হলে অপরাধী যে শুধু ক্ষমা পেত তা নয়, তার প্রিয় ভক্তদের মধ্যে স্থান লাভেও বাধা থাকতো না। আমাদের স্মরণ করতে হবে, মহানবীর সেই প্রিয়তম অনুচর ও সহচরদের কথা-যারা প্রথম জীবনে শুধু তার মতের বিরুদ্ধচারী ছিলেন না, প্রাণের বৈরীও ছিলেন। দাউদ হায়দার অল্প বয়স্ক। এখনো ছাত্র, তাই তার মুক্তি ও পুনর্বাসনের আবেদন জানাচ্ছি। তবে সমীরণ সাহিত্য চক্রের বক্তব্য ছিল- কলমের আঘাত কলম দ্বারা প্রতিরোধ করাই উত্তম। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কবিতাটিকে অশালীন হিসেবে চিহ্নিত করে ঐতিহাসিক বটতলায় প্রতিবাদ সমাবেশ করে। সভায় দাউদ হায়দারকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করা হয়। এছাড়া নাস্তিকতার প্রচার বন্ধের জন্যে বিশেষ পদক্ষেপের আহবান জানানো হয়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
দ ৪
১৯৭৪ এর ২০শে মে সন্ধ্যায় তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ’৭৪-এর ২১শে মে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ নির্দেশে সুকৌশলে কলকাতা-গামী একটি ফ্লাইটে তাকে তুলে দেয়া হয়। ওই ফ্লাইটে সে ছাড়া আর কোনও যাত্রী ছিল না। তাঁর কাছে সে সময় ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগ (ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দু’জোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ।) কবির ভাষায়, ‘আমার কোন উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল।’
ভারতে গিয়েও রক্ষা পাননি কবি। শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমান এর নির্দেশে তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। হাইকমিশনার তাঁর বাসায় গিয়ে, বাসা মানে দাউদ হায়দার ভারতে যাঁর আশ্রয়ে থাকতেন সেই বাড়ীতে গিয়ে পাসপোর্ট নিয়ে আসে। ভারত সরকার তাঁকে ভারত ত্যাগের ফাইনাল নোটিশ দেয়- “… য়্যু হ্যাভ নো কেইস ফর গ্রান্ট অব লংটার্ম ষ্টে ফ্যাসিলিটিজ ইন ইন্ডিয়া এন্ড য়্যু আর দেয়ারফর রিকোয়েষ্টেড টু লীভ ইন্ডিয়া ইম্মিডিয়েটলি উইদাউট ফেইল।” ১৯৮৫ সালে পেন আমেরিকান সেন্টারের ২০০০ লেখকের পক্ষ থেকে ভারতের প্রধান মন্ত্রীর কাছে একটা চিঠি লেখা হয় যাতে দাউদ হায়দারকে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়ার অনুরোধ করা হয়। এর পিছনে কবির বন্ধু অন্নদাশঙ্কর রায়ের প্রভাব ছিল।
এর পর নোবেল লরিয়েট জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস ভারত সফরে এসে পুরো ঘটনা শুনলেন। কথা দিয়ে গেলেন তাঁকে “তোমার জন্য কিছু একটা করবো। তিনি জার্মান সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত কবিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ২২ শে জুলাই ১৯৮৭ এর কোনো এক ভোরে জার্মানির বার্লিনে গিয়ে পৌঁছান কবি দাউদ হায়দার। জাতিসংঘের বিশেষ ‘ট্রাভেল ডকুমেন্টস’ নিয়ে এখন ঘুরছেন দেশান্তরে। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে তিনি আটক পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন করেন। তার পাসপোর্ট ফেরতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এরশাদ সরকারও। এরশাদের আমলে ঘোষণা করা হোল, “এই লোক বাংলাদেশের জন্য সন্দেহজনক”- এই মর্মে পৃথিবীর যেসব দেশে বাংলাদেশ দূতাবাস আছে, সেই সব দেশে নোটিশ পাঠানো হল। নোটিশে বলা হল- “এই ব্যক্তিকে সরকারের পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে কোনো পাসপোর্ট প্রদান করা যাইবে না। তাহার নাম সন্দেহজনক ব্যক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করিতে হইবে।’
বর্তমান সরকারও কবিকে দেশে আসার অনুমতি দেননি। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জার্মানি সফরে গেলে বাংলাদেশের নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কবি দেশে ফেরার ব্যাপারে তার আকুতির কথা জানান মন্ত্রীকে। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন দেশে ফেরার জন্য। কিন্তু সেই আবেদনে সরকার সাড়া দেয়নি। দেশে প্রবেশের সরকারী বাঁধার বিষয়ে কবি বলেন, এই ৪১ বছরেও আমি জানতে পারিনি অথবা জানানো হয়নি কী অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে। এটি সরকারের দায়িত্ব। এখন যেহেতু জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাই তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে আমাদের মানবাধিকার সুরক্ষায় সহায়তা দেওয়া। চার দশকের বেশি প্রবাসে কাটানো এই কবি জানান, যে কবিতার জন্য উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর হুমকিতে পড়েছিলেন তার সেই কবিতা শতাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সময় ওইসব দেশের মানুষ তার কবিতা নিয়ে আলোচনা করেন। দেশে ফেরার আগ্রহের বিষয়ে দাউদ হায়দার বলেন, “নিজের জন্মভূমির মাটি, আলো-বাতাসের মত কোনকিছুই আপন হয় না। বার্লিনেও আকাশ রয়েছে, মাটি রয়েছে, গাছপালা রয়েছে। কিন্তু কোনটিই আমাকে আপন ভাবে না। আমিও ভাবতে পারি না। এটি কখনো হয় না। মাটির টান কত যে প্রবল তা বলে বুঝাতে পারব না।”
দাউদ হায়দারকে নিয়ে এতো কথার বলার কারণ হল, তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত লেখক। যিনি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছেন। অনেক বড় ঘরের সন্তান ছিলেন বলে হয় তো সরকার তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দেন। এছাড়া সাপ্তাহিক ২০০০ এ প্রকাশিত হওয়া তার আত্মজৈবনিক লেখা ‘সুতানটি সমাচার” ২০০৭ সালে ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত দেয়ার অভিযোগে সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
শিবব্রত নন্দী পুরো কবিতাটাই তাঁর ডায়েরিতে সে সময় টুকে রাখেন। এই কবিতাটা যখন ছাপা হয়, তখন তিনি বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকতেন নাজমুল আহসান হলে। তখন নাজমুল আহসান হল টিনশেডের। হলের কমনরুম থেকে কবিতাটা তিনি ডায়েরিতে তুলে নেন। আজ বিয়াল্লিশ বছর পরেও সেই ডায়েরি অক্ষত অবস্থায় রয়েছে তাঁর কাছে। শিবব্রত নন্দী থেকে কবিতাটি সংগ্রহ করেন ফরিদ আহমেদ।

দাউদ হায়দার ‘কালো সুর্য্যের কালো জ্যোত্স্নায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লেখার কারণে দেশ ছাড়েন। এছাড়াও ১৯৭৩ সালে ‘London Society for Poetry’ তাঁর এক কবিতাকে “the Best Poem of Asia” সম্মানে ভুষিত করে। ঢাকার কোন এক কলেজের শিক্ষক ঢাকার একটি আদালতে এই ঘটনায় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। বলা হয় এই মামলা অতঃপর মৌলবাদীদের হুমকি ধমকি থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্যই ১৯৭৪ সালে কবিকে ‘Protective Custody’ তে নেওয়া হয়। অদ্ভুদ বিষয় হল কালো সুর্য্যের কালো জ্যোত্স্নায় কালো বন্যায় ” কবিতাটি’র বাংলা কবির কাছেও নেই। কবিতাটির ইংরেজী অনুবাদও করা হয়।

কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়

দাউদ হায়দার
প্রকাশকালঃ ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪
জন্ম আমার কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায়
ভেসে এসেছি তোমাদের এই তিলোত্তমা শহরে
কল্পিত ঈশ্বর আমার দোসর; পায়ে তার ঘুঙুর; হৃদয়ে মহৎ পূজো
চুনকামে মুখবয়ব চিত্রিত; আমি তার সঙ্গি,
যেতে চাই মহীরুহের ছায়াতলে, সহি নদীজলে; ভোরের পবনে।
ঈশ্বর একান্ত সঙ্গি; জ্বেলেছি ধূপ লোবানের ঘরে। তার পায়ের ঘুঙুর সে
আমাকে পরিয়ে পালালো, আমি উঠলুম আমি।
ভেতরেও সে বাহিরেও সে; আমার আমি হয়ে চলেছি আমি,
মরণের নক্ষত্র দোদুল্যমান কালো ঘণ্টার রাজধানীতে বর্শার মতো দিন।
রাত্রির অলীক নটী, অন্ধদ্বন্দ্বে নাচায় ভাই; আমার বিশ্বাস ছিল
প্রতিধ্বণী নেই, তিমিরে আমার যাত্রা; দেখা হয় আলখেল্লায়
সজ্জিত মিথ্যুক বুদ্ধ; বসে আছে বোধিদ্রুমের ছায়াতলে;
যিশু আরেক ভণ্ড; মোহাম্মদ তুখোড় বদমাস; চোখে মুখে রাজনীতি,
আমি প্রত্যেকের কাছে পাঠ নিতে চাইলুম; তোমাদের চৈতন্যে যে লীলাখেলা
তার কিছু চাই এবেলা। দেখলো ঈশ্বর দেখলো আদম।
আদমের সন্তান আমি; আমার পাশে আমি?
আমি আমার জন্ম জানি না। কীভাবে জন্ম? আতুরের ঘরে কথিত
জননী ছাড়া আরে কে ছিল? আমায় বলে নি কেউ।
আমার মা শিখালো এই তোর পিতা, আমি তোর মাতা।
আমি তাই শিখেছি। যদি বলতো, মা তোর দাসী, পিতা তোর দাস;
আমি তাই মেনে নিতুম। কিংবা অন্য কিছু বললেও অস্বীকারের
উপায় ছিল না।
আমি আজ মধ্য যৌবনে পিতা মাতার ফারাক বুঝেছি। বুঝেছি সবই মিথ্যা
বুঝেছি কেউ কারও নয়; কেউ নয় বলেই তো বলি
একদিন সবকিছুই যাবে চলে (চলে যাবে)।
Every things passes, one day every thing will go yet
We shall not recognise each other, and indirect love
remain hesitant as the desires of life time shall roam
the winds and blue sky.
এই তো সনাতন নিয়ম; ব্যতিক্রম নেই পরিবর্জিত অজাত শত্রু আমার।
প্রেম সে কি? কোথায় থাকে? কার জরায়ু থেকে নেমে আসে?
কেউ নিঃসঙ্কোচে বলতে পারো?
বারবার আমি বেয়োগের চৈতন্যে বাহু রাখি। স্মৃতি আমার অকাল পাথর।
জীবে প্রেম? মানুষে মানুষে ভালবাসা? প্রেম অশ্রু আমার
ভোঁতা। এ্যরিষ্টোটল, প্লেটো, আমার চৈতন্যে; তাদের চৈতন্যই
আমার বিশ্বাস।
নীটসের কথাই ঠিক; ঈশ্বর মরেছে আমার শৈশবে,
অতএব সে আমায় ঘুঙুর পরিয়ে পালালে সে আজ নেই,
তার জারজ সন্তানেরা অলীকের চৌমাথায় বসে পাণ্ডুর প্রেমের কথা বলে।
লোক জমে, বাহবা দেয়; ঔষধ কেনে; ঘরে ফেরে; দেখি সব ফিকে।
আমি জনমে জনমে শূন্য গর্ভে ফিরে আসি।
নূপুর মিশ্রিত অধীর সঙ্গীতের বিরহের কাল বৈশাখীর শ্বাশতের করি না বন্দনা।
আমাতে উল্লাস আছে লগ্ন নেই; সার্থক বুদ্ধিতে বিষ্ণু দে আজ করিঃ
আমার প্রিয়; অপ্রিয় সুধীর দত্তও নয় বটে,
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এড়াতে পারেননি এ বড় দুঃখের কথা।
যুগল স্তনে যৌবন দেখা দিলে তুমি বল প্রেম স্মৃতি।
একি তোমার নিজস্ব অভিলাষ? মাঝে মাঝে রাত্রি কালে হেঁটে যাই;
কোথা যাই সঠিক জানি না।
পথ জানে না আমার গন্তব্য কোথায়; আমি তার কোন কেন্দ্রে গিয়ে
আশ্রয় নেবো। এমন মমতা দেখে খুঁজে ফেরে চরণ চিহ্ন; চরণ চিহ্ন
সহসা হারিয়ে যায়।
শোণিতে খেলা নেই নিস্ক্রিয় নিশ্চল।
আমি তোমায় খুঁজেছি; সীমান্তে আত্মদান করেছ কিনা জানি না,
মহাকাল আমার পদতলে। নিমীলিত চক্ষে আকাঙ্ক্ষার স্পষ্টতা।
পুরানে আমার বিস্ময়; কি করে অসাধ্য সাধন করা যেত?
আমার বন্ধুদের চেয়েও বুদ্ধিদীপ্ত? আপন বিশ্বাসে আমার কাটলো
মিথ্যা তাই বলি, প্রেম মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা।
সব কবিই একই ফুটবল নিয়ে ঘুরছেন গোল স্টেডিয়ামে, রেফারী নেই
হ্যান্ডবল, ফাউল ধরছেন কেউ? আমরা দর্শক কিছুই বুঝি না খেলা দেখি
আশা মিটে গেলেই ঘরে ফিরি। গোল করার কায়দাও মনে রাখি না।
কিন্তু সবাই তো চৌকস খেলোয়াড় বলটা কাটতে পারেন ভালো;
তবে কেন ঘুরছেন?
সহীসের ঘোড়ার সাথে জীবনানন্দের দেখা হোলো একদিন
মধ্যরাতে আমার সাথে পাল্লা দিয়ে হেরে গেলো-
মনে তার প্রেম ছিল?
মূল্যহীন মূল্যবোধের কতটুকু বিজয়?
আমি দৃষ্টির আড়ালে উচ্চরিনাঃ বলি বিশাল জনসভায়-
তিমিরে আমাদের যাত্রা; তুমি জানো না জানো কিছুই এসে যায় না
এই উড়ন চণ্ডীর, উড়নচণ্ডীরাই মহাপাগল, পাগলের কথার
দাম বিশ্ব ব্যাংকও জানে না।
সাবিত্রী তুমি কি বহ্নির কাছে নতজানু হবে? অমরত্ব হারাবে,
এসে আমার হাতে হাত রাখো; অমৃতের দিকে চোখ ফিরিও না
তোমায় সামনে বসিয়ে মন্থর করে এঁকে যাবো
সমস্ত শরীর চুল চিবুক।
এখন আকাবোকা সব শেষ
সামনে যে অন্ধকার আগামী উৎসবে আরো দ্বিগুণ হবে।
প্রতীক্ষায় লাভ নেই, আমার বক্ষে মাথা রাখো শোন আগমনী বার্তা
কালো মৃত্যুর দিন সমাগত,
তুমি শান্তির প্রেমের কথা বলো। বলেছে আদমের সন্তানেরা শান্তি কোনদিন
আসবে না, কৌতুক নয়। অন্ধ সংসারে সেই কোরে প্রেম।
পাতালে গিয়েছ কোন দিন? কিংবা আকাশ নীলিমায়?
দেখেছ এ্যাপোলো? মন্বন্তরে সেকি যায়নি ভেসে? স্বরচিত গানে
আনন্দ পাও? ইন্দ্রপাল লক্ষ কোরেছো কোনদিন?
বিজ্ঞাপন বড় সুন্দর একদিন কৃষ্টি হবে পায়রা আসবে কার ঘরে? কোন ঘরে
তোমারই স্মরণে?
তোমার মুখে স্তনে কিসের দাগ? ঘোমটায় কোথায় চলেছো তুমি?
পেছনে আমার ভাই; অন্ধ ছন্দে সেই কৃষ্ণ; রাধা নেই,
আমার পদপ্রান্তে নিঃসঙ্কোচে লুটাক আদমের সন্তান; ঈভের প্রেম
ফাঁদের অলীক প্রেমে আমি আলো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়
তোমাদের শ্বাশতীরে খুঁজে পাইনি। কেউ পায়না চলে গেছে,
সব চলে গেছে, চলে যায়; বুঝি তাই বলে যাই
Even when our eyes meet shall not recognise each other
Even we walk past each other we shall not see. One day
Our bodies shall be together. One day we shall be
tern from the struggles of life.
We shall have the silent procession and move
towards a redbirth, and I shall call you again and
again. And when you do not answer I shall
go to that phanton land
when we shall stand face
in perfect union. One day
you and I shall go to that landscape. And
yet no one shall recognize other.

স্বাধীনতা ০০০০


গোলাপের স্বাধীনতা আছে পাঁপড়ি মেলার
ভ্রমরের স্বাধীনতা আছে ফুলের মধু খাবার
মেঘের স্বাধীনতা আছে আকাশে ভাসার
বাতাসের স্বাধীনতা আছে পাতায় দোল খাবার
বৃষ্টির স্বাধীনতা আছে গ্রাম প্রান্তর ভিজিয়ে দেবার
ঝরণারা স্বাধীনতা আছে পাহাড় থেকে নীচে ঝরার
পাখীর স্বাধীনাতা আছে হাওয়ায় হাওয়ায় ঘুরার
মাছের স্বাধীনতা আছে জলেতে সাঁতার কাটার
নদীর স্বাধীনতা আছে সমুদ্রের পাণে চলার
আকাশের স্বাধীনতা আছে নীল ছাড়াবার
সূর্যের স্বাধীনতা আছে অন্ধকার তাড়াবার
চাঁদের স্বাধীনতার আছে রূপালী আলো দেবার

খাবলে খেয়েছে মায়ের শরীর যারা স্বাধীনাতা নাই তাদের
স্বাধীনতা নাই নিঃস্বাস নেবার মুক্ত বাতাসে মূর্হুত এদের...